হজের ইহরাম বাঁধার নিয়ম - হজ্জের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও পালন পদ্ধতি
হজ্জের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও পালন পদ্ধতি
সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ এবং দরূদ ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর উপর বর্ষিত হোক যার পরে আর কোন নবী নেই, আরো বর্ষিত হোক তার পরিবার-পরিজন ও সাহাবাবৃন্দের উপর।
হজ্জ বিষয়ক ইসলামী জ্ঞানদান সংস্থা আল্লাহর সম্মানিত ঘরের হাজীদের খেদমতে এই ক্ষুদ্র নির্দেশিকাটি পেশ করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দবোধ করছে। হজ্জ ও উমরার কিছু আত্কাম এতে রয়েছে। এর সূচনায় এমন কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ অসিয়ত আমরা পেশ করেছি।
হজের ইহরাম বাঁধার নিয়ম
আপনি যদি ইফরাদ কিংবা ক্বিরান হজ্জ সম্পাদনকারী হন, তাহলে যে মীকাত হয়ে আপনি আসবেন সে মীকাত থেকে ইহরামের নিয়ত করুন। আর মীকাতের সীমানার মধ্যে অবস্থান করলে নিয়াত অনুযায়ী নিজ স্থান হতে ইহরাম বাঁধবেন। আপনি যদি তামাতুকারী হন, তাহলে মীকাত থেকে উমরাহর ইহরাম বাঁধবেন এবং হজ্জের জন্য তারবীয়ার দিন তথা জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখে নিজ অবস্থানস্থল হতে ইহরামের নিয়াত করবেন। সম্ভব হলে গোসল করে সুগন্ধি ব্যবহার করবেন এবং ইহরামের কাপড় পরিধান করে বলবেনঃ
হজ্জের জন্য আমি হাজির। আমি হাজির হে আল্লাহ্! আমি তোমার দরবারে উপস্থিত। তোমার কোন অংশীদার নেই। তোমার দরবারে আমি হাজির। সর্বপ্রকার প্রশংসা ও নেয়ামতের সামগ্রী সবই তোমার। রাজত্ব তোমারই, তোমার কোন শরীক নেই।
তারপর মীনার দিকে রওয়ানা হবেন। মীনায় যোহর, আসর, মাগরিব, এশা এবং ফজরের নামায আদায় করবেন। চার রাকাত বিশিষ্ট নামাযগুলো কসর করে দু'রাকাত পড়বেন, কিন্তু জমা' করবেন না।
যিলহজ্জ মাসের ফযীলত ও আমল
জিলহজ্জ মাসের নবম দিনে সূর্য উদয়ের পর মীনা হতে আরাফাতের দিকে ধীরে সুস্থে শান্ত ভাবে রওয়ানা হতে হবে। চলার সময় হাজী সাহেবদেরকে যাতে কোন রকম কষ্ট দেয়া না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। আরাফাতে পৌঁছে সেখানে যোহর ও আসরের নামায যোহরের ওয়াক্তে এক আযান ও দু'একামত দ্বারা কসরসহ একত্রে আদায় করবেন।
আপনি আরাফাতের সীমানার ভেতর প্রবেশ করেছেন এ ব্যাপারে অবশ্যই নিশ্চিত হবেন। সেখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পূর্ণ অনুসরণ করে কেবলামুখী হয়ে দু'হাত ঊর্ধ্বে তুলে বেশী বেশী আল্লাহ্ পাকের যিক্র ও দোয়া পাঠ করবেন। উল্লেখ্য যে, আরাফাতের প্রান্তর পুরোটাই অকুফের স্থান। এ প্রান্তরের যে কোন স্থানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করতে হবে।
সূর্য অস্ত যাওয়ার পর ধীরে সুস্থে তালবিয়া পাঠ করতঃ মুযদালিফার উদ্দেশ্যে গমন করবেন। পথে চলার সময় কোন মুসলিম ভাইকে কষ্ট দেবেন না। সেখানে পৌছেই মাগরিব ও এশার নামায একত্রে পড়বেন এবং এশার নামায কসর করবেন। ফজরের নামায পড়ে ভোরের আলো ফর্সা হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করবেন। আর ফজরের নামাযের পর কেবলামুখী হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অনুকরনে দু'হাত ঊর্ধে তুলে অধিক মাত্রায় আল্লাহ্র যিক্র ও দোয়া করবেন।
হজের পাঁচ দিনের ধারাবাহিক কার্যাবলি
অতঃপর সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে তালবিয়া পড়তে পড়তে মীনার দিকে যাত্রা করবেন। হজ্জ পালনকারী ব্যক্তি যদি ওজরগ্রস্ত লোকদের অন্তর্গত। হয়, যেমন নারী অথবা দুর্বল হয়, তাহলে রাতের শেষার্ধে মীনায় রওয়ানা হলে কোন দোষ নাই। জামরাতুল আকাবায় নিক্ষেপের জন্য শুধুমাত্র সাতটি কঙ্কর আপনার সাথে নেবেন।
আর বাকী কঙ্কর মীনা থেকে সংগ্রহ করবেন। অনুরূপভাবে ঈদের দিন জামরাতুল আকাবায় নিক্ষেপের জন্য সাতটি কঙ্করও আপনি মীনা থেকে নিতে পারেন। মীনায় পৌছার পর নিম্নলিখিত কাজগুলো আপনি সম্পাদন করবেনঃ
- (ক) জামরাতুল আকাবায় (মক্কার সবচেয়ে নিকটবর্তী জামরাহ) পর পর সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন এবং প্রত্যেকটি নিক্ষেপের সময় 'আল্লাহু আকবার বলবেন। যদি আপনার উপর হাদী ওয়াজিব হয়ে থাকে, তাহলে তা জবেহ করবেন, নিজে তা হতে খাবেন এবং গরীব-মিসকীনকেও খাওয়াবেন।
- (গ) মাথার চুল হলক করবেন অথবা ছোট করবেন। তবে হলক করাই উত্তম। মহিলারা তাদের চল আঙ্গুলের অগ্রভাগ পরিমাণ কেটে ছোট করবে। উপরোক্ত ধারাবাহিকতা রক্ষা করা উত্তম। কিন্তু যদি এর মধ্যে কোনটি আগে-পরে হয়ে যায়, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই।
আপনি যখন জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। এবং চুল হলক করবেন বা ছাঁটবেন, তখন প্রাথমিকভাবে হালাল হয়ে যাবেন। এরপর আপনি কাপড় পরিধান করতে পারবেন এবং স্ত্রী সহবাস ছাড়া ইহরাম অবস্থার অন্য সকল নিষিদ্ধ কাজ আপনার জন্য হালাল হয়ে যাবে।
জিলহজ মাসের করণীয় আমল এবং কোরবানির ফজিলত
তারপর মক্কায় এসে তাওয়াফে ইফাদা করবেন। এরপর সায়ী করবেন, যদি তামাত্তু হজ্জ করে থাকেন। আর যদি আপনি কিরান কিংবা ইফরাদ হজ্জ করে থাকেন এবং তাওয়াফে কুদুমের পর সায়ী করে ফেলেন, তাহলে এক্ষেত্রে পরবর্তীতে আপনাকে আর কোন সায়ী করতে হবে না। তাওয়াফে ইফাদার পর স্ত্রী সম্ভোগসহ ইহরামের সকল নিষিদ্ধ কাজ সিদ্ধ হয়ে যাবে।
মীনার দিবসগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপের পর পর্যন্ত তাওয়াফে ইফাদা ও সায়ীকে বিলম্বিত করা জায়েয আছে। কুরবানীর দিন তাওয়াফে ইফাদাহ ও সায়ী করার পর মীনায় ফিরে আসবেন এবং সেখানে ১১, ১২ ও ১৩ই জিলহাজ্জের রাত্রিসমূহ অর্থাৎ তাশরীকের তিনদিন কাটাবেন। আর যদি দু'দিন কাটিয়ে প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছুক হন, তবে তাতে অসুবিধা নেই।
আরো পড়ুনঃ নবীজীর রওজা মোবারক জিয়ারতের নিয়ম
দু' অথবা তিনদিন মীনায় অবস্থানকালে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার পর তিনটি জামরাতেই কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। প্রথম জামরাহ থেকে কঙ্কর নিক্ষেপ শুরু করবেন। এটি মক্কা হতে সবচেয়ে দূরবর্তী জামরাহ। এরপর মধ্যবর্তী জামরায় এবং সর্বশেষে জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। প্রত্যেক জামরায় পর পর সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন এবং প্রতিবার আল্লাহু আকবার বলবেন।
প্রথম ও দ্বিতীয় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর কেবলামুখী হয়ে দু'হাত তুলে ইচ্ছামত আল্লাহ্র কাছে দোয়া করবেন এবং জামরায় আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপের পরে আর দাঁড়াবেন না। যদি কেউ তাশরীকের দু'দিন মীনায় থেকে মীনা হতে চলে আসতে চায়, তবে তাকে দ্বিতীয় দিন সূর্যাস্তের আগেই মীনা হতে বের হতে হবে।
যদি মীনা হতে বের হওয়ার পূর্বে সূর্য অস্ত যায়, তবে তৃতীয় দিনও মীনায় থেকে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। উল্লেখ্য, মীনাতে তিন দিন অবস্থান করাই উত্তম। অসুস্থ ও দুর্বল লোকেরা যদি তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা কঙ্কর নিক্ষেপের কাজ করে, তবে তা জায়েজ হবে। প্রতিনিধিদের জন্য প্রথমে নিজের তরফ থেকে এবং পরে স্বীয় মুয়াক্কিলের তরফ থেকে একই স্থানে দাঁড়িয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করা জায়েজ।
হজ্জের কাজ সম্পন্ন করার পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে কাবা শরীফের তাওয়াফ করতে হবে। এই তাওয়াফের নাম তাওয়াফুল বিদা' বা বিদায়ী তাওয়াফ। যে নারী হায়েয বা নেফাসের মধ্যে রয়েছে সে ছাড়া অন্য কারো জন্য এ তাওয়াফ পরিত্যাগ করার অনুমতি নাই।
মুহরিম ব্যক্তির জন্য যা ওয়াজিব
যে ব্যক্তি হজ্জ বা উমরাহের ইহরামের মধ্যে রয়েছে, নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো তার উপর ওয়াজিবঃ
- (১) আল্লাহ্ তা'লা তার উপর দ্বীনের যে সমস্ত ফরযসমূহ অপরিহার্য করে দিয়েছেন তা পরিপূর্ণভাবে মেনে চলা। যেমন প্রতিটি নামায যথাসময়ে জামায়াতের সাথে আদায় করা ইত্যাদি।
- (২) আল্লাহ্ তা'লা যে সমস্ত কাজ নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। যথা : স্ত্রী সহবাস, বেহুদা গুনাহমূলক ও বিবাদ-বিসম্বাদমূলক কথাবার্তা ও কাজকর্ম ইত্যাদি।
- (৩) কথা ও কাজে কোন মুসলমানকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা।
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কার্যাবলী হতে দূরে থাকা। এগুলো নিম্নরূপঃ
- (ক) দেহের কোন অংশের চুল বা নখ কর্তন করা। কিন্তু যদি তা আপনা আপনি পড়ে যায়, তাহলে কোন দোষ নাই।
- (খ) শরীর, কাপড়, খাদ্য বা পানীয়ের মধ্যে সুগন্ধি ব্যবহার করা। কিন্তু যদি ইহরামের পূর্বেকার ব্যবহৃত সুগন্ধির আছর থেকে যায়, তাহলে তাতে কোন দোষ নেই।
- (গ) ইহরাম অবস্থায় কোন স্থলচর জন্তু শিকার করা, অথবা সেটাকে তাড়া করা কিংবা কোন শিকারীকে শিকারে সাহায্য করা।
- (ঘ) ইহরাম অবস্থায় কোন নারীকে বিয়ের পয়গাম দেয়া এবং নিজের জন্য কিংবা অপরের জন্য বিবাহের আকদ করা। আর ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করা কিংবা কামভাবের সাথে স্ত্রীকে স্পর্শ করা।
উপরোক্ত নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের যেগুলো পুরুষদের জন্য খাস তা হলোঃ
মাথার সাথে লেগে থাকে এমন কিছু দ্বারা মাথা ঢাকা। তবে ছাতা বা গাড়ীর ছায়ায় অবস্থান করা কিংবা মাথার উপর বোঝা চাপানো দোষনীয় নয়। শরীরকে পুরোপুরি বা আংশিক ঢেকে ফেলে এমন জামা বা অনুরূপ কিছু পরিধান করা কিংবা টুপী, পাগড়ী, পাজামা ও মোজা ব্যবহার করা। তবে যদি লুঙ্গি যোগাড় করতে সক্ষম না হয়, তবে সে ক্ষেত্রে পাজামা ব্যবহার করতে কোন দোষ নেই।
আরো পড়ুনঃ নামাজের কাফফারা কি
অনুরূপভাবে যদি কেউ জুতা সংগ্রহ করতে না পারে, তবে তার পক্ষে মোজা ব্যবহার করা দোষনীয় নয়। ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের জন্য হস্তদ্বয়ে দস্তানা (হাত মোজা) পরিধান করা এবং নেকাব বা বোরকা দ্বারা মুখ ঢাকা হারাম। তবে মাহরাম নয় এমন পর পুরুষের উপস্থিতিতে ওড়না অথবা ঐ জাতীয় জিনিষ দ্বারা চেহারা ঢাকা ওয়াজিব, যেমনিভাবে ইহরামের অবস্থা ছাড়াও পর পুরুষের উপস্থিতিতে ওড়না বা অনুরূপ কাপড় দ্বারা মুখ আবৃত করা ওয়াজিব।
যদি কোন পুরুষ ইহরাম অবস্থায় ভুল করে বা অজ্ঞতা বশতঃ সেলাই করা কাপড় পরে অথবা মাথা ঢেকে রাখে, অথবা সুগন্ধি ব্যবহার করে কিংবা মাথার চুল বা নখ কাটে, তাহলে তাকে ফিদিয়া দিতে হবে না। এমতাবস্থায় যখনই সে বিষয়টির হুকুম জানবে কিংবা স্মরণ করবে, তখনই নিষিদ্ধ বস্তুটি পরিত্যাগ করা তার উপর ওয়াজিব।
ইহরাম অবস্থায় জুতা পরিধান করা, আংটি ও চশমা ব্যবহার করা, কানে শ্রবণযন্ত্র লাগানো, হাতে ঘড়ি বাঁধা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা টাকাপয়সা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেল্ট ও পেটি ব্যবহার করা জায়েজ। ইহরাম অবস্থায় কাপড় বদলানো ও কাপড় পরিষ্কার করা এবং মাথা ও শরীর ধোয়া জায়েজ আছে।
এমতাবস্থায় যদি অনিচ্ছায় মাথার চুল পড়ে যায়, তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই। অনুরূপভাবে কোন আঘাত পেলেও তার উপর কিছু ওয়াজিব হবে না।