গোলাপ গাছের ডাল-পালা ছাঁটাইয়ের প্রয়োজনীয়তা কী - গোলাপ গাছের পরিচর্যা কিভাবে করতে হয়
গোলাপ গাছের ডাল-পালা ছাঁটাইয়ের প্রয়োজনীয়তা কী এবং গোলাপ গাছের পরিচর্যা কিভাবে করতে হয় এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এ আটাকিলটি পড়তে হবে।
এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করছি গোলাপ গাছের ডাল থেকে চারা তৈরি এবং গোলাপ গাছে কি সার দিতে হয়। এছাড়া আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়ার অনুরোধ রইলো।
গোলাপ চাষ করার পদ্ধতি
মাটিঃ যথেষ্ট পরিমাণে জৈব পদার্থ আছে, এমন দোঁ-আশ মাটি দরকার। জমিতে জল নিষ্কাশনের সুবন্দোবস্ত থাকা চাই। বর্ষাকালে পুকুরের জল যতদূর ওঠে, জমিকে হ'তে হবে তা থেকে অন্ততঃ ১ হাত উঁচু। সামান্য অম্লধর্মী বা অম্লক্ষার-নিরপেক্ষে জমিতে গোলাপ চাষ ভাল হয়।
পরিবেশঃ দিনে যেন ৬/৭ ঘন্টা রোদ গাছে লাগতে পারে এমন জমি দরকার। আর দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ বাতাস। এর জন্য গোলাপ গাছের আশে-পাশে উঁচু কোনও গাছ লাগানো উচিত নয়।
গোলাপ গাছের পরিচর্যা কিভাবে করতে হয়
চারা তৈরীঃ বসন্তকালে চোখ কলমের দ্বারা গোলাপের চারা তৈরী করা যায়। এর জন্য চাই এলা। উন্নত গোলাপের চোখ অর্থাৎ কক্ষ মুকুল তুলে এলার (এলার বয়স ১-১২ বছর হলে ভাল) গায়ে বসাতে হয়। এলা অর্থাৎ বুনো সহনশীল জাতের গোলাপ গাছ যার প্রতিটি ডালে থাকে ৭টি করে পাতা। এতে ফুল হয় না।
এলার ছোট চারা মেলে নার্সারিতে। অথবা এলা টুকরো করে কেটে টবে/মাটিতে বসিয়ে সেচ দিয়ে চারা তৈরী করতে হয়। এর জন্য চৌকো, রোদযুক্ত পটে খোল, গোবর সার, হাড় ও শিং-এর গুঁড়ো দিয়ে মাটি বানান। ১৫ দিন এভাবে রাখার পর ৪ ইঞ্চি অন্তর এলা বসান। এলা চারা থেকে বের হওয়া ডালের ৩/৪ট পাতা রেখে ছেঁটে দিন।
এবার উন্নত গোলাপের গা থেকে বড় পাতার ডাঁটি সমেত খুলে দিয়ে চোখটা ব্লেড দিয়ে এমনভাবে তুলুন যাতে সেটা ছাল সমেত ঠিক ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। (চোখের সাথে পাতা যেন না থাকে) কেটে নেওয়া এই চোখের ছালের নীচের কাঠ অংশটাকে ব্লেড দিয়ে তুলে ফেলে দিন। এবার এলার মাটি সংলগ্ন জায়গায় ১টা গাঁট ছেড়ে কাণ্ডের ছালটা 'T'-এর মতো করে চিরে ব্লেড দিয়ে ছালটা 'T'-এর মতো করে চিরে ব্লেড দিয়ে ছালটা 'T'-এর ওপর দিক থেকে একটু আলগা করে দিন।
এবার চোখ সমেত ঐ২ ইঞ্চিছালটুকু ঢুকিয়ে দিন ঐ 'T'-এর ওপর থেকে নীচের দিকে ঠেলে, চোখটাকে ঐ ছালের নীচে চাপা পড়বে না। শুধু ছালটুকু ছালের তলায় চাপা এই অবস্থা পাতলা প্লাসটিকের টেপ আর সূতো দিয়ে চেপে বাঁধুন। বারংবার জল দিয়ে জায়গাটা ভেজান। ১৪-২০ দিনেই মুকুল বাড়তে থাকবে।
মকুল বেড়ে উন্নত গোলাপের শাখা বাড়তে থাকবে। তখন ঐ নতুন গজানো ডালের ওপর থেকে এলা ছেঁটে নিন। কিছুদিন পরেই ফুল আসবে গোলাপের ডালে। এক্ষেত্রে কয়েকটা কথা মাথায় রাখতে হবে- মুকুল শুকনো বসাবেন না। চোখ তুলে পাত্রে জল দিয়ে তাতে রাখুন। চোখটা বসানোর পর ঐ চোখ বসানোর জায়গাটা জল দিয়ে ধুয়ে দেবেন। রেড মাইটসের উৎপাত থেকে বাঁচতে ১০ লিটার জলে ১০ মিলি লিটার ডাইকোফল জাতীয় ওষুধ মিশিয়ে স্প্রে করুন।
গোলাপ গাছের ডাল থেকে চারা তৈরি
চারা রোপনঃ অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে গোলাপের কলম বসানোই ভাল। হাইব্রিড টি শ্রেণীর জাতির ক্ষেত্রে ৬০ সেমি প্রতি সারি ও ৩০ সেমি প্রতি গাছ ব্যবধান রেখে চারা বসাবেন। ঝাঁকালো জাতির ক্ষেত্রে, সারিতে ও গাছে ৭৫ সে.মি. দূরত্ব রাখবেন। মিলিয়ে চার শ্রেণীর জাতিতে সারি ও গাছের দূরত্ব থাকবে ৩০ সে.মি.।
লতানে শ্রেণীর জাতিতে দূরত্ব থাকবে ৩ মিটার। সারপ্রদান: চারা পোঁতার ১২ মাস পরে কাণ্ডের ১০-১২ সে.মি. ছেড়ে চারপাশের হাল্কা সেচ দেওয়া জমিতে ৩০-৪০ সে.মি. পর্যন্ত মাটি হাল্কাভাবে খুঁড়ে প্রতি গাছের জন্য ৫-৬ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে সেচ দিন। এ সময় স্টেরামিল, রোজমিক্স, র্যালিমিল প্রভৃতি মিশ্রসার প্রয়োগ করা যায়। ১ মাস পর প্রতি গাছে একইভাবে ৩-৪ গ্রাম করে ইউরিয়া দেবেন।
গোলাপ গাছের ডাল-পালা ছাঁটাইয়ের প্রয়োজনীয়তা কী
গাছ ছাঁটাইঃ সব গাছ একই সাথে ছাঁটাই না করে অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে কিছু কিছু গাছ ছাঁটাই করুন। ছাটাই-এর ১০-১৫ দিন আগে থেকে জমিতে সেচ দেবেন না। নিড়ানি দিয়ে মাটি আগাছা মুক্ত করে ডাল ছাঁটাই করবেন। প্রথম বছরে ডাল ছাঁটাই করা হয় প্রধানতঃ গাছকে নির্দিষ্ট কাঠামো দেওয়ার জন্য।
প্রথমে শুকনো, রোগাক্রান্ত, নিস্তেজ ডাল গুলোকে এবং গাছের কেন্দ্রস্থলের দিকে মুখ করে ওঠা ডালগুলোকে গোড়া থেকে কেটে দিন। সবল, বাড়ন্ত, ডালগুলোর তিনভাগের একভাগ রেখে বাকিটা কেটে দিন। ডাল কাটবেন বহির্মুখী কোনও চোখের ঠিক ওপরে। ডালে থাকা চোখ থেকে পরে গজানো অন্তর্মুখী ডালভেঙে বহির্মুখী কচি ডালই শুধু রাখবেন।
দ্বিতীয় বছর ডাল ছাঁটাই করা হয় ফুলের জন্য ও নির্দিষ্ট আকার দেওয়ার জন্য। এই বছরেও রুগ্ন, অন্তর্মুখী ডালকে গোড়া থেকে কেটে দেবেন। সেই সঙ্গে অন্য ডালের বৃদ্ধি অবরোধকারী ডাল, আগের বছর নতুন ডাল বের করতে পারেনি এমন যে সব ডাল, তাদেরও গোড়া থেকে কেটে দেবেন। আগের বছরের প্রধান ও বহির্মুখী ডালগুলোর অংশ রেখে বাকি অংশ কেটে দিন।
ডাল কাটবেন যথারীতি চোখের ঠিক ওপরে। গাছের কেন্দ্রস্থলে কোনও ডাল রাখবেন না। প্রতি বছরই এভাবে ডাল ছাঁটাই করতে হবে। যে সব গাছে ডালাপালা কম, তাদের বেশী করে ছাঁটাই করতে হয়। অর্থাৎ খুব কম অংশে ডাল রেখে বাকী অংশ কেটে দিতে হয়।
গোলাপ ফুলের বৈশিষ্ট্য
- গোলাপ ফুলের সাদা, হলুদ ও হাল্কা রঙের ফুলের জাতির তুলনায় গাঢ় লাল ও কালো রঙের ফুলের জাতির গাছের ছাঁটাই বেশী ক'রে করতে হয়।
- হাইব্রিড টি (গ) শ্রেণীর জাতির চেয়ে ফ্লোরিবাণ্ডা শ্রেণীর জাতির অপেক্ষাকৃত কম ছাঁটাই লাগে। পলিয়্যেনথা শ্রেণীর জাতির ছাঁটাই লাগে আরও কম।
- মিনিয়েচার শ্রেণীর জাতির ও লতানো শ্রেণীর গাছে ছাঁটাই লাগে না। তবে শুকনো, রুগ্ন, জীর্ণ ডালগুলোকে কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয়।
- একটা গাছ ছাঁটাই এরপর কাঁচিটা স্পিরিট দিয়ে মুছে ফেলুন। কেটে ফেলা ডালগুলোকে বাগান থেকে সরিয়ে দিন।
গোলাপ গাছের খাবার
মাজরা পোকার প্রতিরোধে প্রতি ১ লিটার জলে ১ মিলিলিটার ১ লিটার জলে ১ গ্রাম ব্লাইটক্স গুলে স্প্রে করুন, ছাঁটাই এরপর। তাছাড়াও ৪ ভাগ ক'রে রেডলেড্, কপার কার্বোনেট, ৫ ভাগ তিসির তেল মিশিয়ে ডাল-এর কাটা অংশ গুলোর ওপর তুলি দিয়ে প্রলেপ দিন। শিকড় অনাবৃতকরণ: ডাল ছাঁটাই এর ঠিক পরেই গাছের কেন্দ্রস্থলের প্রধান শিকড়গুলোকে উন্মুক্ত করতে হয়।
এর জন্য প্রতি গাছের কাণ্ডের ঠিক নীচে প্রায় ১৫-২০ সে.মি. করে গভীর ও কেন্দ্রস্থল থেকে চারপাশে প্রায় ৩০-৪০ সে.মি. দূর পর্যন্ত মাটি তুলে ফেলুন যাতে গাছের ঠিক নীচে গর্ত তৈরী হয়। গর্ত থেকে তোলা মাটি তার পাশেই রেখে রোদ খাওয়ান। এ গর্ত তৈরী হওয়ার ফলে প্রধান শিকড়গুলো অনাবৃত হয়ে পড়বে। এইরকম অবস্থায় শিকড় ৭-১০ দিন রেখে গর্ত থেকে তোলা মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে গর্তগুলো ফের বুজিয়ে দিন।
গোলাপ গাছে কি সার দিতে হয়
ডাল ছাঁটাই ও শিকড় উন্মুক্তকরণের পরবর্তী পরিচর্যা- শিকড় উন্মুক্ত করণের ৭-১০ দিন পর প্রতি গাছের নীচের খোঁড়া গর্তে ১ কেজি গোবর সার, ৩০০ গ্রাম পাতা পচা সার, ১৫০ গ্রাম খোল, ১০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫ গ্রাম ফসফেট, ৮ গ্রাম মিউরিয়েট অব পটাশ গর্ত থেকে তোলা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্তে ঠেসে ভরাট করুন।
গর্ত ভর্তি হওয়ার পরই সেচদিন। সেচ দেওয়ার পর মাটি বসে গেলে ও মূল বেরোলে ফের সারমাটি দিয়ে বসা জায়গা ভরাট করুন। এর ১৬ দিন পর ফের ১০ গ্রাম ইউরিয়া গাছের চারপাশে ছড়িয়ে সেচ দিন। এই সময় স্টেরামিল, রোজমিক্স, অর্গামিল, র্যাথিমিল প্রভৃতি মিশ্রসার প্রয়োগ করা যায়। ছাঁটাই-এর ৪/৫ সপ্তাহ পর নতুন ডাল গজালে ১ অন্তর ২ ভাগ ইউরিয়া, ১ ভাগ করে পটাশিয়াম নাইট্রেট, পটাশিয়াম ফসফেট ডাই-হাইড্রোজেন অ্যামোনিয়াম ফসফেট মিশিয়ে ১ লিটার জলে ২ গ্রাম গুলে কীটনাশক ওষুধ মেটাসিসটক ২ মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করুন।
কুঁড়ি আসার ঠিক আগে ৪২ লিটার জলে ২০ গ্রাম সবুজ তুঁতে গুলে একবার স্প্রে করুন। রোগদমন: ছাঁটাই এরপর হ'তে পারে শুকোরোগ। এতে ডাল ওপরের দিক থেকে শুকোতে শুরু করে। পাতাও ঝরে যায়। রোগদমনের জন্য আক্রান্ত অংশ ছেটে সমান অংশ বি.এইচ.সি. (১০%) ও ব্লাইটক্স জলে মিশিয়ে লেই বানিয়ে ক্ষতে লাগান।
গোলাপ গাছের রোগ প্রতিরোধ কিভাবে করতে হয়
ব্ল্যাকম্পটের ক্ষেত্রে পাতার দু'দিকে কালো দাগ পড়ে। দাগের সংখা বেড়ে পাতা ঝল্ল্সে যায়। পাউডার মিলভিউ-এর ক্ষেত্রে টোকা দিলে পাতা থেকে সাদা পাউডার গুঁড়োর মত ছত্রাকগুলো ঝরে পড়ে। মরচে ধরা রোগের ক্ষেত্রে পাতার নীচে কালচে খয়েরী দাগ দেখা যায়। রোগ সার পাতায় ছড়িয়ে গিয়ে পাতাকে শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে দেয়।
এই সবকটি রোগ দমনের জন্য ১ লিটার জলে ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন গুলে পরপর ২-৩ সপ্তাহ ধরে গাছেও পাতায় ছেটান। প্রতি লিটার জলে ২খানি ভিটামিন ট্যাবলেট, ১০ গ্রাম প্ল্যান্টোমাইসিন মিশিয়ে গাছে দিলে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ হয় না। ফুল ভাল হয়। গাছের রোগ প্রতিরোধক শক্তি বাড়ে। এই গাছে জাবপোকা, সবুজ মাছি, লেদাপোকা, ফড়িং, উই, কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, কক চেকার মাকড়, রোজ বিটল প্রভৃতি কীটের আক্রমণ দেখা যায়। প্রয়োজনমত রোগের ৩০, ই.সি. স্প্রে করবেন। মাকড়ের মহৌষধ হ'ল সালফেক্স।