নামাজের কাফফারা কি - নামাজের কাফফারা কিভাবে দিতে হয়
নামাজের কাফফারা কি এবং মৃত ব্যক্তির নামাজের ফিদিয়া বা কাফ্ফারা এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব। এ বিষয়ে আরো তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি সালাতের কাযা আদায় করা যাবে কি? বা কাফফারা না দিলে কি হয় এছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়া অনুরোধ রইল।
ভূমিকা
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত। মৃত ব্যক্তির নামাজের ফিদিয়া বা কাফ্ফারা এ জীবন ব্যবস্থা একদিকে যেমন পরিপূর্ণ অন্যদিকে সুস্পষ্ট। এতে গোঁজামিলের কোন সুযোগ নেই। এর প্রতিটি বিধান বাস্তবে অনুশীলন করে দেখানো হয়েছে। রাসূল (সাঃ) কর্তৃক প্রদর্শিত এ জীবন বিধানের নামই তাঁর সুন্নাত। আর বিদআত হলো শরীয়তে যার কোনো ভিত্তি নেই এমন কিছু দ্বীনের মধ্যে উদ্ভাবন করা।
নামাজের কাফফারা কিভাবে দিতে হয়
আমাদের দেশের কোনো কোনো 'আলেম মৃত্যুর পূর্বে কোনো ব্যক্তির বাদ পড়ে যাওয়া সালাতের নির্ধারিত কাফ্ফারার প্রচলন করেন। এ ক্ষেত্রে তারা রোযার সাথে একে তুলনা করে থাকেন। অথচ এভাবে কোনো 'ইবাদতের প্রচলন করার ইখতিয়ার কারো নেই। ইসলামের মৌলিক 'ইবাদতের মধ্যে সালাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
আরো পড়ুনঃ দোয়া কবুলের পরীক্ষিত আমল
সালাতের বিষয়টি অন্যসব মৌলিক 'ইবাদতের চাইতে ব্যতিক্রম। অন্যসব মৌলিক 'ইবাদতের কাফ্ফারাহ অথবা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ আছে। কিন্তু সালাতে তা নেই। শারীরিক অসুস্থতা কিংবা অপারগতার দোহাই দিয়ে তা অন্যকে দিয়ে আদায় করা যাবে না। কিংবা কোনো আর্থিক কাফফারার বিনিময়েও সালাতকে বাদ দেয়া যায় না।
ব্যক্তির মস্তিষ্ক বিকৃত না হওয়া পর্যন্ত তথা হুশ থাকা অবস্থায় তার জিম্মা থেকে সালাতের দায়িত্ব রহিত হয় না। সে দাঁড়ায়ে না পারলে বসে পড়বে, বসতে না পারলে শুয়ে পড়বে, শুতে না পারলে যেভাবে সে সক্ষম সেভাবে ইশারা-ইঙ্গিতে হলেও সালাত আদায় করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন: "যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে, আর আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে চিন্তা করে এবং বলে- হে আমাদের রব! তুমি নিশ্চয়ই এগুলোকে অযথা সৃষ্টি করোনি।
পবিত্র ও মহান তোমার সত্তা। আমাদেরকে তুমি আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করো।" 'আয়িশাহ্ সিদ্দিকা (রাযিয়াল্লা-হু আনহু) বলেন: রাসূল (সাঃ) তার প্রতিটি মুহূর্তেই মহান আল্লাহর কথা স্মরণ করতেন।
সালাতের কাযা আদায় করা যাবে কি?
সালাত এবং সালাতের বাইরে রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: "তুমি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করো, যদি তা (দাঁড়াতে) না পারো তাহলে বসে সালাত আদায় করো। যদি তাও (বসতেও) না পারো তাহলে (শুয়ে) তোমার পার্শ্ব ফিরেই সালাত আদায় করো। " প্রকৃত কথা হলো- সালাত কাযা করার কোনো সুযোগ মূলতঃ ইসলামী শরীয়তে রাখা হয়নি।
আরো পড়ুনঃ সারাদিনের দুআ ও যিকির সংক্রান্ত আলোচনা
তাই এর কোনো কাফ্ফারারও প্রশ্ন আসে না। ব্যক্তির জ্ঞান লোপ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে সালাত আদায় করতেই হবে। যদি তার জ্ঞান লোপ পেয়ে যায়, অথবা সে ঘুমে থাকে এমতাবস্থায় তার উপর সালাত ফরয থাকে না। কিন্তু যখনই সে জ্ঞান ফিরে পাবে ও ঘুম থেকে জেগে উঠবে এবং তার মনে পড়বে যে, সে সালাত আদায় করেনি, অথবা মারাত্মক কোনো বিপদের কারণে তার একাধিক সালাত কাযা হয়ে গেছে, তখন সে শীঘ্রই সালাতগুলো আদায় করে নেবে।
আর যদি এ সুযোগ আসার আগেই সে মৃত্যু বরণ করে তাহলে তার অপারগতার কারণে আল্লাহ তা'আলা তাকে পাকড়াও করবেন না; বরং মাফ করে দেবেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তি সচেতন ও সজ্ঞান থেকে, বুঝে শুনে ইচ্ছে করে বছরের পর বছর বেপরোয়াভাবে সালাত ত্যাগ করে চলবে আর মৃত্যুর সময় যৎ-সামান্য কাফ্ফারা দিয়ে পার পেয়ে যাবে, তা কি করে হতে পারে?
কাফফারা না দিলে কি হয়
এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর সুস্পষ্ট ঘোষণা হলো- আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লা-হু আনহু) থেকে বর্ণিত। নবী (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোনো সালাতের কথা ভুলে যায় সে যেন তা তখনই পড়ে নেয়, যখন তার তা স্মরণ হয়। এটি ছাড়া এর আর কোনো কাফফারা নেই। অন্য বর্ণনায় এভাবে এসেছে- "অথবা কেউ যদি সালাতের ব্যাপারে বেখেয়াল হয়ে যায়, তাহলে তার কাফ্ফারাহ হলো যখনই সালাতের কথা স্মরণ হবে তখনই তা পড়ে নেবে।
আরো পড়ুনঃ আজান ও ইকামতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস
অতএব সালাতের ক্ষতিপূরণ কেবল সালাত দিয়েই হতে পারে। ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা দিয়ে কিংবা অন্যকোনো ব্যক্তিকে দিয়ে বদলা আদায়ের মাধ্যমে এর ক্ষতিপূরণ হবে না, যেমনটি রোযা, হজ্জ ইত্যাদির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। অনেকে পুরো যৌবনকালটাই বেনামাযী হয়ে কাটিয়ে দেয়। তার এক সময়ে সমবয়সী কারো মৃত্যুর পর বোধ ফিরে আসে। তিনি কি তখন 'উমরি কাযা করবেন? না তার ক্ষেত্রেও সঠিক তাওবাই হলো এর একমাত্র সমাধান।
মৃত ব্যক্তির নামাজের ফিদিয়া বা কাফ্ফারা
আমাদের দেশের এক শ্রেণির 'আলেম মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর আগে রোগশয্যায় থাকাকালীন যে কয় ওয়াক্ত সালাত পড়তে পারেনি, সে কয় ওয়াক্ত সালাতের কাফ্ফারা ধরে তা পরিশোধ করার জন্য তাকিদ করে থাকে। এ ব্যক্তির উপর দশ বছর বয়সে যে সালাত ফরয হয়েছিল সে মৃত্যু পর্যন্ত কত শত ওয়াক্ত সালাত আদায় করেনি, তার কোনো কাফ্ফারা হিসাব করা হয় না।
আবার সালাত ছাড়া তার গোটা জীবনে যে, আরো কত ফরয বাদ পড়েছে, সেগুলোর কাফ্ফারাহ কি হবে তাতো হিসাব করা হয় না। বিশেষতঃ যাকাতের ব্যাপারটিতো কখনো হিসাব করা হয় না। আর এটি কি করেই বা হিসাব করা সম্ভব? উপরন্ত শির্ক, বিদআত ও অসংখ্য হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে সে যে পাহাড়সম গুনাহ কামিয়েছে তারই বা কি হবে?
শুধু বিগত কয়েক ওয়াক্ত সালাতের কাফ্ফারাহ দিয়েই কি মুক্তি পাওয়া যাবে? যদি তা না হয়, তাহলে সালাতের কাফ্ফারাহ এরূপ মনগড়া প্রথা চালু করে এ প্রহসন দেখানো হচ্ছে কেন? শরীয়তের বিধানকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন এবং বিয়োজন করে নতুন বিধান রচনা করার ইখতিয়ার ইসলাম কাউকে দেয়নি।
আমাদের সমাজের অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমকে তাদের নিজেদের জীবনে বাদ পড়ে যাওয়া সালাতগুলোর কাযা করতে দেখা যায়। তাদের কেউ কেউ প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্তের সালাতকে দু'বার করে আদায় করেন। একটি হলো সেদিনের ওয়াক্তিয়া সালাত, আর একটি হলো অতীতের বাদ পড়ে যাওয়া ঐ ওয়াক্তের সালাত। এই সালাতকে তারা 'উমরি কাযা বলে অভিহিত করেন। কিন্তু কুরআন ও সুন্নায় এই সালাতের কোনো ভিত্তি নেই। সালাত হলো সময়ের সাথে বেঁধে দেয়া একটি 'ইবাদত। আজিকারী
কাফফারা কখন দিতে হয়
সময় না আসলে এই 'ইবাদতটি বান্দাহর উপর ফরয হয় না। আর কোনো কারণে সময় চলে গেলে পরবর্তী নিকটতম সময়ে মনে হওয়া বা সুযোগ হওয়া মাত্রই এটি আদায় করে নেয়া একজন মু'মিনের উপর ফরয। সময়ের বাইরে আদায় করা এই সালাতকে কাযা বলে। কারো নিকটতম অতীতের এক বা একাধিক সালাত এভাবে না পড়া হয়ে থাকলে তিনি তা কাযা হিসেবে ধারাবাহিকভাবে আদায় করে নেবেন।
আর ভবিষ্যতে এরূপ না করার ব্যাপারে মহান আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ করে ওয়াদাবদ্ধ হবেন। কিন্তু মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কেউ সালাত না পড়ে থাকলে পরবর্তী মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর সংশ্লিষ্ট এ সালাতের সময় তার অতীতের সালাতের কাযা করার কোনো বিধান ইসলামী শরীয়তে নেই; বরং এ সুযোগ থাকলে মানুষ প্রায়শঃই এভাবে কারণে অকারণে সালাত বাদ দিয়ে থাকবে, আবার পরবর্তীতে নিজের সুবিধামত কাযা করতে থাকবে।
অথচ কোনো মানুষের এটা জানা নেই যে, সে আগামী ওয়াক্তের সালাতের সময় বেঁচে থাকবে কি- না। সম্ভবতঃ এ কারণেই ইসলামে নারীদের অসুস্থতা জনিত কারণে বাদ পড়ে যাওয়া সালাতগুলোও পরবর্তীতে আর কাযা করতে হয় না। এরূপ বিধান থাকলে এটা মানুষের জন্য মারাত্মক বোঝা হয়ে যেত এবং সালাত কাযা করার ব্যাপারেও মানুষ বেপরোয়া হয়ে যেত।
নামাজের কাফফারা কি
মানুষের দীর্ঘ সময়ের বাদ পড়ে যাওয়া অতীতের সালাতের ব্যাপারে তাই ইসলামের বিধান হচ্ছে সঠিকভাবে তাওবাহ্ করে ফেলা। আর পরবর্তীতে দৈনন্দিন সালাতকে তার জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আদায়ের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া। রাসূল (সাঃ)-এর বয়স্ক সাহাবীগণ ইসলাম গ্রহণের পর তাদের অতীতের বড় বড় পাপের ব্যাপারে তাদের করণীয় জানতে চাইলে তিনি তাদেরকে এ উপদেশ দিতেন এবং বলতেন: "ইসলাম অতীতের সব কিছুকে মিটিয়ে দেয়।” অর্থাৎ- কোনো ব্যক্তি নতুন করে ইসলামে প্রবেশ করলে তার অতীতের সমস্ত পাপ মোচন হয়ে যায়।
তাই অতীতের পাপের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির সঠিকভাবে অনুশোচিত হওয়ার অর্থই হলো যে, তিনি তার ভবিষ্যত জীবনে আর সে পাপ করবেন না এবং অন্যান্য পূণ্য কাজ তিনি বেশি বেশি করবেন। রাসূল(সাঃ)-এর সাহাবীগণ তাই করতেন। তাদের কাউকে অতীতের বাদ পড়ে যাওয়া সালাতের 'উমরি কাযা করতে দেখা যায়নি। অবশ্যই আমাদের সমাজে যারা বুঝে শুনে ইসলাম গ্রহণ না করে কেবল বংশানুক্রমে মুসলিম তাদের বেলায় এমনটি হয়ে যেতে পারে।
শেষ কথা
ইসলামের পক্ষ থেকে এরূপ সুযোগ প্রাপ্তির পর তাওবাহ্ করে পরিপূর্ণরূপে ইসলামের বিধানের দিকে ফিরে আসাই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব। আর নিজের অতীতের গুনাহের কথা চিন্তা করে ভবিষ্যত জীবনে ইসলামের পক্ষে নিজের সকল ভূমিকাকে আরো শানিত করাই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা 'উমরি কাযা একটি সুস্পষ্ট বিদআত এবং শুধু বিদআতই নয় এটি ইসলামের আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ারও শামিল।