বিভিন্ন রকমে লেবু চাষ পদ্ধতি - লেবু চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতি

বিভিন্ন রকমে লেবু চাষ পদ্ধতি এবং লেবু চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতি এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করা হলো।
চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতি
এ আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি কোন সময় লেবু চাষ ভালো হয় এবং লেবুর গুনাগুন। এছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইল।

লেবুর বৈজ্ঞানিক নাম


লেবুর বৈজ্ঞানিক নাম (Scientific name): Citrus Spp.
গোত্রঃ (Family or Natural order): Rutaceae.

ভূমিকা


পৃথিবীর সব ফলের মধ্যে লেবু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল এবং উপক্রান্তীয় সব ফলের মধ্যে লেবু তৃতীয় স্থান অধিকার করে আছে। ভারতেরও এটি একটি তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফল। ফল চাষের মোট জমির নয় শতাংশ জমিতে লেবুর চাষ হয়। আসাম, মেঘালয়, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও রাজস্থান লেবু উৎপাদনের অন্যতম অঞ্চল। 

এছাড়া হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, গুজরাট, বিহার ও উড়িষ্যার অল্প বিস্তর জমিতে লেবুর চাষ হয়। লেবু জাতীয় ফলগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ভারত ও চীনে সর্বপ্রথম উৎপত্তি হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল লেবুর জন্মস্থানের অন্যতম অঞ্চল বলে বিবেচনা করা হয়।

লেবুর গুনাগুন


লেবুতে খাদ্যপ্রাণ (Vitamin)-সি ও দরকারী নানা প্রকারের খনিজ পদার্থ থাকে। এছাড়া ফলের রসে ফল শর্করা (Fructose), সামান্য পরিমাণে ফল অম্ল (Citric acid), খনিজ পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ এবং সোডিয়াম ও পটাসিয়ামঘটিত লবণ আছে। সাইট্রিক অম্ল বেশী থাকায় লেবু স্বাদে অম্ল। স্যালাড ও সরবৎ তৈরী করতে এবং অন্যান্য খাদ্যের স্বাদ বা সুগন্ধ বাড়ানোর জন্যে লেবু ব্যবহৃত হয়। 

কতিপয় লেবুতে (যেমন বাতাবী, কাগজী ইত্যাদি) পেকটিন বেশী থাকায় মার্মালেড ও জেলী করার কাজে ব্যবহার করা যায়। পাতিলেবুর আচার তৈরী করা হয়। লেবুর রস সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যায়। লেবুর খোসার রন্ধে তৈলাক্ত পদার্থ থাকে। কমলা লেবু ও কাগজি লেবুর ফলত্বকের সুগন্ধি তেল সুগন্ধি দ্রব্য তৈরী করতে ব্যবহৃত হয়।

বিভিন্ন প্রকার লেবুর নাম


লেবুর বিভিন্ন শ্রেণী আছে। যথাঃ
  • ১. গন্ধরাজ লেবু (Lemon Citrus limon Burm F.)
  • ২. কাগজী লেবু (Lime Citrus aurantifolia Swingle.)
  • ৩. মিষ্টি বা মুসম্বীলেবু (Sweet orange or Mosambi Citrus sinensis Osheck)
  • ৪. সরবতী লেবু (Citron or Sweet Lume - Citrus lime oides Tanaka)
  • ৫. বাতাবী লেবু (Pummelo Citrus grandis L/C. maxima Merill)
  • ৬. গ্রেপ ফুট (Grape fruit Citrus paradisis Macf.)
  • ৭. কমলালেবু (Mandarin or loose skin Orange: C. reticulata Blance) 
পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি কমলালেবু চাষের জন্যে বিখ্যাত।

কোন সময় লেবু চাষ ভালো হয়


কমলালেবু (Orange)
কমলালেবু উপক্রান্তীয় অঞ্চলের ফল; কমলালেবু অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ও বেশী বৃষ্টিপাত পছন্দ করে। কমলালেবু উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে অধিক আর্দ্রতা সম্পন্ন জলবায়ুতে জন্মে থাকে। সেজন্যে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায়, আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড় অঞ্চলে প্রচুর কমলা লেবু জন্মায়। বৃষ্টি বেশী হলে ও বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকলে ফলের রস বেশী হয় ও খোসা পাতলা হয়। ফলের স্বাদ পানসে হয় ও ফলে ঠিকমত রঙ আসে না। বৃষ্টি না হলে সেচ দিয়ে বেশ ভালভাবে কমলালেবুর চাষ করা চলে।

কাগজী ও পাতিলেবু (Lime & Lemon)
ভারতবর্ষের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে কাগজী ও পাতিলেবু ভাল জন্মায়। এরা ঠাণ্ডা ও তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। উত্তর ভারতের অপেক্ষাকৃত শুষ্ক অঞ্চলে কাগজী ও পাতিলেবু চাষ করা যায়।

বাতাবী লেবু (Pummelo)
বাতাবী লেবু বেশী বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা পছন্দ করে। শুষ্ক, ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও তুষারপাত এই লেবুর পক্ষে অনুপযোগী। পশ্চিমবঙ্গে বাতাবী লেবু ভাল জন্মায়।

মুসম্বী লেবু (Sweet orange or Mosambi)
মুসস্বী লেবু উপক্রান্তীয় জলবায়ু পছন্দ করে এবং বেশী ঠাণ্ডা ও তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। ফল পাকার সময় গরম আবহাওয়া দরকার। উত্তর ভারতের সমতল ভূমি, যেখানে শীত খুব মৃদু, সেখানে মুসম্বী লেবু জন্মাতে পারে।

লেবু চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতি


লেবু নানারকম মাটিতে জন্মে। মধ্যভারত ও অন্ধ্রে কৃষ্ণ মৃত্তিকাতে, পাঞ্জাবে বেলে মাটিতে, সিন্ধু-গাঙ্গেয় অববাহিকার গভীর পাললিক মাটিতে এবং খাসিয়া, দার্জিলিং ও বিন্ধ্যাচলের লাল পাহাড়ী মাটিতে লেবুর চাষ হয়। লেবু চাষের সাফল্য মাটির ধর্মের (যেমন মৃত্তিকার বিক্রিয়া, মৃত্তিকার উর্বরতা, জলনিষ্কাশন ক্ষমতা, চুন ও লবণের ঘনত্ব প্রভৃতি) ওপর নির্ভর করে। লেবু গভীর, আলগা মাটিতে ভাল জন্মে। মাটির পি-এইচ.৫.৫-৭.৫ লেবু চাষের পক্ষে আদর্শ। লেবুর প্রকার অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন মাটি দরকার। যেমনঃ লেবুর

কমলালেবু (Orange) চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতি


জলনিকাশযুক্ত দোআঁশ মাটিই কমলা লেবুর পক্ষে ভাল। নাগপুর অঞ্চলে যেখানে এর চাষ করা হয়, সেখানে আছে কালো এঁটেল মাটি এবং তার খানিকটা নীচেই মোরাম। খাসিয়া পাহাড়ে কমলালেবুর বাগানের জমি কাঁকুড়ে বা বেলে, পাঞ্জাবে হালকা বেলে মাটিতেই কমলালেবুর বাগান গড়ে উঠেছে।

কাগজী ও পাতিলেবু (Lime & Lemon) চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতি


দোআঁশ, বেলে দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ ও পলিমাটিতে কাগজী ও পাতিলেবু জন্মায়। জমিতে জলনিকাশের ভাল ব্যবস্থা থাকা দরকার।

বাতাবী লেবু (Pummelo) চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতি


বাতাবী লেবু হাল্কা থেকে ভারী মাটিতে জন্মায়। তবে পাললিক মৃত্তিকা বাতাবীলেবু চাষের পক্ষে সব চেয়ে বেশী উপযোগী। জমিতে জল নিকাশের ভাল ব্যবস্থা থাকা দরকার।

বিভিন্ন রকমে লেবু চাষ পদ্ধতি


কমলালেবু লেবু (Orange)
কমলালেবুর বীজ থেকে ও কলম করে চারা তৈরী করা যায়। বীজের চারা গাছের লেবু টক হতে পারে। তবে বীজের গাছ বাঁচে বেশী দিন ও প্রচুর ফল দেয়। কমলালেবুর বীজগুলো অনেক সময় বহু ভূণীয় (Poly embryony) হয়ে থাকে। একটা লেবুর বীজ থেকে অনেক চারা হতে পারে। এর মধ্যে একটি চারা পরাগ সংযোগে ও বাকীগুলো বীজের ভেতরের কোষ থেকে উৎপন্ন হয়। 

কোষ থেকে উৎপন্ন চারাগুলোকে নিউসেলার (Nucellar) চারা বলে। এসব চারা বেশ সতেজ ও নীরোগ হয়। এছাড়া বীজ থেকে বের হলেও কলমের চারার মতই এগুলো গুণগত ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পূর্ণ হয়। জামির জাতীয় (C. jambhiri) লেবুতে সবচেয়ে বেশী (প্রায় শতকরা ৯১টি) নিউসেলার চারা পাওয়া যায়। পাকা লেবু থেকে বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বুনতে হবে। 

ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে ও ছাই মাখিয়ে বীজের হড়হড়ে পদার্থটা নষ্ট করতে হবে। তারপর জলে ধুয়ে ও ছায়ায় শুকিয়ে বীজতলায় বীজ বুনতে হবে। রোদে শুকালে বীজ নষ্ট হয়ে যায়। বীজ রেখে দিলে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হ্রাস পায়। সেজন্যে ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করেই বীজতলায় বোনা দরকার। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণতঃ বীজ বোনা হয়। 

মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে মে-জুন মাসে বীজ বোনা হয়। কমলা লেবুর চোখ কলম (যেমন T-বাডিং, ফোরকার্ট বাডিং ইত্যাদি) করে বংশবিস্তার করা যায়। মালটা, মোসাম্বী প্রভৃতি জাতের মূলাধার হিসাবে (Root stock) জাম্বিরীকে (C. jambhiri) এবং সনত্রার জন্যে পাতিলেবু ও রঙপুর লেবুর চারা ব্যবহার করা হয়। 

ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে চোখ কলম করা হয়। এই চারাগুলোকে নার্শারীতে এক বছর লালন পালন করার পর স্থায়ী জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়। বর্ষাকালে চারা (জুলাই-আগষ্ট) রোপণ করা উচিৎ।

কাগজী ও পাতিলেবুঃ বীজ, শাখা কলম, দাবাকলম (Layering), গুটি কলম (Air layering) ও চোখ কলম প্রকৃতি স্বাদ যে এই শ্রেণীর লেবুর চারা তৈরি করা যায়।
বাতাবি লেবুঃ বীজ থেকে ও কলম পড়ে (যেমন গুটিকলম চোখ কলম প্রভৃতি চারা) তৈরি করা যায়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন