দ্রুত ঘুম আসার উপায় - ঘুম নিয়ে ভালো উক্তি

দ্রুত ঘুম আসার উপায় এবং ঘুম নিয়ে ভালো উক্তি এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
দ্রুত ঘুম আসার উপায়
শিশু এবং বয়স্করা কতক্ষণ ঘুমাবেএই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি স্লিপ প্যারালাইসিস কেন হয় এবংকেন ঘুম পায়? এছাড়া আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইল।

ভূমিকা


গালিয়ার্সই। বিশ্বখ্যাত বীর। সারাপৃথিবীকে পদানত করার স্বপ্ন যে দেখতে শিখেছিল খুব ছোটবেলা থেকেই। নিজেকে তৈরিও করেছিল সেভাবেই। দেশের পর দেশ জয় করে, ধ্বংসলীলা চালিয়ে, মানুষ হত্যা করে গালিয়ার্সই ভীষণ মজা পেত, রক্তে ছিল তার খুনের নেশা। কিন্তু রাতে দু'চোখের পাতা সে এক করতে পারত না।

ঘুম নিয়ে ভালো উক্তি


গালিয়ার্দইর মাকে সবাই বলত খুনির মা, বেঈমানের মা। রণক্লান্ত সেই বীর বহুদিন পরে একদিন এল মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। বলল, 'মা, আমি তোমার কাছে একটু ঘুমাতে এসেছি, তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শোেব আমি।' মায়ের কোলে মাথা গুঁজে দিল গালিয়ার্দই। মা তার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে শোনাতে লাগল সেই ছোটবেলার মতো ঘুমপাড়ানি গান। 

গভীর ঘুমের দেশে পাড়ি দিল গালিয়ার্সই। তার মা এবার কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা একটি ছুরি বের করে হত্যা করল তার সেই খুনি পুত্রকে। চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিল গালিয়াদইকে। কিন্তু তারপর থেকে সেই মা তার দু'চোখের পাতা আর কোনো দিনই বন্ধ করতে পারেনি। বিনিদ্র রজনী তাকে কাটাতে হয়েছে আমৃত্যু। 

ম্যাক্সিম গর্কি তার বিখ্যাত গল্প 'মাদার অফ অ্যা ট্রেটার'-এ ঘুমকে এভাবেই করুণ ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছেন। ঘুমের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল বাদলের কথা। সম্প্রতি চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়েছেন। স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক দিন। শিফটিং ডিউটি করতেন খবরের কাগজের অফিসে। ঘুমের কোনো বাঁধাধরা সময় ছিল না, জাগতে হয়েছে রাতের পর রাত। 

ভেবেছিলেন অবসর জীবনে সুদে-আসলে পুষিয়ে নেবেন। তা আর হয়ে উঠল কই? নিজের বায়োলজিক্যাল ক্লকটাই যে বিগড়ে গিয়েছে এতদিনে। ঘুম আর আসে না। বৈকালিক ভ্রমণসঙ্গীদের পরামর্শে এটা-ওটা অনেক কিছুই করলেন, ঘুমের বড়িও খেলেন অনেকদিন। নিট রেজাল্ট শূন্য। বিরক্ত হয়ে মাঝরাতে একদিন রেডিও খুলে বসলেন। 

এফ এম চ্যানেলে ভেসে এল জগন্ময় মিত্রর গান 'তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন আমারে-আমারে...।' গানের পর গান। ফিরিয়ে নিয়ে এল প্রায় ৪৫ বছর আগের যৌবনের দিনগুলো। অদ্ভুত নস্টালজিয়া। গান শুনতে শুনতে আবেশে আবেগে হারিয়ে গেলেন বাদল। ঘুমিয়েও পড়লেন একসময়।

ঘুম কাকে বলে?


ঘুম। দু'অক্ষরের এই ছোট শব্দটিকে দু'কথায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ঘুম যে ঠিক কী, কেন পায়, কেন পায় না, কখন পায়-এ নিয়ে পৃথিবীজুড়েই কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা। কেউ বলেন, ঘুম হলো চেতন এবং অচেতন স্তরের মধ্যবর্তী অবস্থা যখন মানসিক ক্রিয়া কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ থাকে কিন্তু শারীরিক ক্রিয়া ঢিলেতালে হলেও চলতে থাকে। 

কেউ বলেন, জেগে থাকার, ঠিক বিপরীত অবস্থাই হলো ঘুম। বিজ্ঞানীরা বলেন, 'স্লিপ ইজ অ্যা রেকারেন্ট রিভারসিবল কন্ডিশন অব মাসকিউলার ইনারশিয়া অ্যান্ড রিডিউসড সেন্সরি রিঅ্যাক্টিভিটি টু এনভায়রনমেন্টাল স্টিমুলাই'। তত্ত্বকথা থাক। আমাদের কাছে ঘুম ঘুমই। নিরবচ্ছিন্ন এক প্রশান্তি, বেঁচে থাকার রসদ।

কেন ঘুম পায়?


ঘুম হলো মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত এক প্রতিবর্ত ক্রিয়া। আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলে রয়েছে স্লিপ সুইচ। এই সুইচই নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের ঘুম। এটা আসলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের সামনের অংশের একগুচ্ছ বিশেষ ধরনের কোষ, যে অঞ্চলটাকে 'ব্রেইন অফ দ্য ব্রেইন'-ও বলা হয়ে থাকে। এই স্নায়ুকোষগুলো থেকে এক ধরনের রাসায়নিক সংকেত হাইপোথ্যালামাসের পেছনে বিশেষ আরেকটি অঞ্চলে পৌঁছলেই আমাদের ঘুম পায়। আবার পেছন থেকে উল্টোপথে এই সংকেত হাইপোথ্যালামাসের সামনে পৌঁছলে আমরা জেগে উঠি।

স্লিপ প্যারালাইসিস কেন হয়


এই স্লিপ সুইচ আবার দেহের বায়োলজিক্যাল ক্লকের সঙ্গে তাল রেখে চলে। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঠিক কতক্ষণ আমরা ঘুমাব, কতক্ষণই বা জেগে থাকব তার একটা ছন্দ বেঁধে দিয়েছে দেহের জৈব ঘড়ি, যে ছন্দকে বলে সার্কেডিয়ান রিদম। এসব ঘুম তত্ত্ব জানা গেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ক্লিফোর্ড সাপারের নেতৃত্বাধীন একদল গবেষকের গবেষণা থেকে। 

প্রতিটি মানুষেরই ঘুমের একটা নিজস্ব ছন্দ অর্থাৎ সার্কেডিয়ান রিদম আছে। আবেগ, উত্তেজনা, অবসাদসহ নানা ধরনের অনুভূতি এই ছন্দকে সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে পাল্টে দিতে পারে। ২০০২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হওয়ার পর বহু আমেরিকাবাসীর বায়োলজিক্যাল ক্লকের সার্কেডিয়ান রিদম পাল্টে গেছে। 

আমাদের সমাজেও এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখি। একমাত্র সন্তানের অকালমৃত্যু বহু মা-বাবার রাতের ঘুম চিরতরে কেড়ে নিয়েছে। পরীক্ষার ঠিক আগে বহু ছাত্র-ছাত্রীই রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে না। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের স্পি সুইচ কখন 'অন' আর 'অফ' হবে এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কোনো স্থির সিদ্ধান্তে এখনও আসতে পারেনি। 

প্রচলিত ধারণা, শারীরিক পরিশ্রম বেশি হলে ঘুম পায়। বেশি খাওয়া-দাওয়া করলেও ঘুম পায় অনেকের। আবার খাটাখাটনি না করেও অনেকে ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়ায় চট করে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তবে একটি ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা মোটামুটি একমত, কোনো কারণে মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহে ঘাটতি পড়লে আমাদের ঘুম পায়।

ঘুম পাড়ায় যারা


হাইপোথ্যালামাসের স্লিপ সেন্টারকে ঠিকঠাক কাজ করতে সাহায্য করে মস্তিষ্কের আরও কয়েকটি অংশ।
  • চোখঃ চোখের রেটিনা থেকে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের অপটিক নার্ভের সাহায্যে খবর পৌঁছায় দিন-রাতের আলোর তারতম্যের। হাইপোথ্যালামাসের সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস (SCN) জেগে থাকা এবং ঘুমিয়ে পড়ার সংকেত পায় চোখ থেকেই।
  • পিনিয়াল গ্রন্থিঃ মস্তিষ্কের এই গ্রন্থিটি মেলাটনিন নামে একটি হরমোনের নিঃসরণ করে, যেটি ঝিমোতে এবং ঘুমাতে সাহায্য করে। সুপ্রাকায়াজম্যাটিক নিউক্লিয়াস এই নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  • পিটুইটারি গ্রন্থিঃ ঘুমের মধ্যে এই গ্রন্থিটি গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ করে যা প্রোটিন সংশেষ এবং ক্ষতিগ্রস্ত কলার মেরামতিতে সাহায্য করে।
  • পন্সঃ পশ্চাৎ মস্তিষ্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি সংকেত পাঠায় সুষুম্নাকাণ্ডকে, তার কাজকর্মের হারকে ঘুমের সময় কমিয়ে আনতে। এরফলেই ঘুমের REM পর্ব শুরু হয়ে যায়।

দ্রুত ঘুম আসার উপায়


নিদ্রাদেবী কীভাবে তার কোলে আপনাকে ঠাঁই দেবেন, তা নিয়েও গবেষণা করেছেন আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা। অনেকে যেমন চাইলেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়তে পারেন, অনেকে তা পারেন না। অনেক সাধ্যসাধনা করে তাকে ঘুম আনতে হয়। নরম বিছানায় শুয়ে, আলো নিভিয়ে, ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে, অন্য সবাইকে জোরে কথা বলতে বারণ করে অনেককে নিদ্রাদেবীর সাধনায় বসতে হয়। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ থাকতে হয়, নানা উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় এসে জোটে, কিছুক্ষণ থেকে আবার চলেও যায়।

প্রাকৃতিক উপায়ে ঘুম আসার ৭ উপায়


ধীরে ধীরে বাইরের জগতের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক ছিন্ন হতে থাকে, শিথিল হতে থাকে দেহের নানা মাংসপেশি। ঘাড়, পিঠ, পা এবং হাতের উপরের দিকের পেশি প্রথমে শিথিল হয়, তারপর হয় হাত- পায়ের আঙুল, পায়ের পাতা, হাতের নিচের দিকের পেশি। এরপর দেহের ছোট পেশিগুলো শিথিল হতে থাকে।
  • ঘুম গভীর হলে কমে যায় হার্ট রেট, পালস রেট, ব্লাডপ্রেসার এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি।
  • ফুসফুসের কাজকর্ম এক-চতুর্থাংশ কমে যায়।
  • শিথিল পেশিগুলোর রক্তনালি প্রসারিত হওয়ার ফলে বেশি পরিমাণ রক্ত সেগুলোতে জমে থাকে। তাই ঘুম থেকে ওঠার পর অনেকের চোখ-মুখ লালচে এবং ফোলা ফোলা লাগে।
  • দেহের বিপাকক্রিয়ার হার ঘুমের মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ কমে যায়। যেজন্য ঘুমের আগে পেট ঠেসে খেতে নেই। খেলে হজম হয় না।
  • স্পর্শ, গন্ধ, দৃষ্টি অনুভূতি ঘুমালে পুরোটাই প্রায় চলে যায়। শ্রবণ অনুভূতি বরং সক্রিয় থাকে।
  • মুখের পেশি শথ হয়ে যাওয়ার ফলে ঘুমালে অনেকের মুখ দিয়ে লালা গড়ায়।
  • কিডনির কাজও কমে আসে এ সময়। যেটুকু ইউরিন তৈরি হয় তা বাডারে গিয়ে জমতে থাকে ধীরে ধীরে। তাই ঘুম ভাঙলেই মূত্রের বেগ হয়।
ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণ আগে থেকে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমরা যখন ঘুমাই তখন কিন্তু আমাদের পুরো মস্তিষ্কটাই ঘুমাই না, কিছু অংশ ঘুমায় কিছু অংশ জেগে থাকে।

যদি ঘুম গভীর হয় তাহলে দেখবেন সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে, কাজকর্মে এনার্জি পাওয়া যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে আচমকা চিৎকার করে কাউকে ডাকবেন না, যদি ডাকতেই হয় খুব মৃদুসরে ডাকবেন আলতো করে দেহ ধাক্কা দিবেন। ভোরবেলা যদি উঠতে হয় ঘড়িতে অ্যালার্ম দিতেই পারেন, তবে ক্লকটা কান থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাখবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন