বিভিন্ন শিল্পে অবাত শ্বসন তথা ফার্মেন্টেশনের ব্যবহার

অবাত শ্বসন
অবাত শ্বসন প্রক্রিয়ায় কোনো মুক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না। যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না বা, অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় তাকে অবাত শ্বসন বলে।
এনজাইম
C6H12O6 → 2C2H5OH+2CO2+20 কিলোক্যালরি শক্তি
গ্লুকোজ     ইথানল
বিভিন্ন শিল্পে অবাত শ্বসন তথা ফার্মেন্টেশনের ব্যবহার

অবাত শ্বসন কিভাবে সংঘটিত হয়? বর্ণনা কর


অবাত শ্বসন দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়।
১. গ্লাইকোলাইসিসঃ এটি সবাত শ্বসনের গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ার অনুরূপ, গ্লাইকোলাইসিস উভয় প্রকার শ্বসনের প্রথম পর্যায়। এ ধাপে এক অণু গ্লুকোজ থেকে ২ অণু পাইরুডিক অ্যাসিড, ২ অণু NADH + H* ও ২ অণু ATP উৎপন্ন হয়।
২ . পাইরুভিক অ্যাসিডের অসম্পূর্ণ জারণঃ পাইরুভিক অ্যাসিড থেকে ইথানল অথবা ল্যাকটিক অ্যাসিড সৃষ্টি: অবাত শ্বসনের দ্বিতীয় পর্যায়ে পাইরুভিক অ্যাসিড অসম্পূর্ণভাবে জারিত হয়ে ইথানল ও CO₂ অথবা শুধু ল্যাকটিক অ্যাসিড সৃষ্টি করে।

ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন


কোষের বাইরে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে জাইমেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে গ্লুকোজ অণু অসম্পূর্ণভাবে জারিত হয়ে ইথানল (অ্যালকোহল) বা ল্যাকটিক অ্যাসিড সৃষ্টি ও অল্প পরিমাণ শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন বলে।

প্রকৃতকোষী এবং আদিকোষী জীবে শ্বসনের স্থান


প্রকৃতকোষী

আদিকোষী

(ক) মাইটোকন্ড্রিয়নের বাইরে (সাইটোপ্লাজমে)

১. গ্লাইকোলাইসিস; ২. ফার্মেন্টেশন

(ক) সাইটোপ্লাজমেঃ

১. গ্লাইকোলাইসিস, ২. ফার্মেন্টেশন। ৩. ক্রেবৃস চক্র

(খ) মাইটোকন্ড্রিয়নের ভেতরে ম্যাট্রিক্স-এঃ . 

৩. পাইরুভিক অ্যাসিড অক্সিডেশন; ৪. ক্রেবৃস চক্র

(খ) প্লাজমামেমব্রেনের ভেতরের তলঃ

৪. ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন

(গ) মাইটোকন্ড্রিয়নের ইনার মেমব্রেন-এঃ

৫. ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন



বিভিন্ন শিল্পে অবাত শ্বসন তথা ফার্মেন্টেশনের ব্যবহার


বিভিন্ন অণুজীবের অবাত শ্বসন প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক শিল্প। নিচে সংক্ষেপে এর কয়েকটি উপস্থাপন করা হলো।
  • বেকারি শিল্পেঃ ঈস্টের ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়াকে এই শিল্পে কাজে লাগানো হয়। ময়দা-চিনির সাথে ঈস্ট যোগ করে পাউরুটি ( তৈরি করা হয়। ময়দা-চিনি ইত্যাদি উপকরণের সাথে মিশ্রিত ঈস্টের শ্বসনের ফলে সৃষ্টি হয় CO, এবং ইথাইল অ্যালকোহল। CO₂ গ্যাস-এর চাপে পাউরুটি ফুলে ফাঁপা হয়; আর অ্যালকোহল তাপে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়।
  • মদ্য শিল্পেঃ ঈস্টের অবাত শ্বসন তথা ফার্মেন্টেশনকে কাজে লাগিয়ে মদ তৈরি করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় আঙ্গুরের রস থেকে ওয়াইন এবং আপেলের রস থেকে সিডার প্রস্তুত করা হয়।
  • অ্যালকোহল প্রস্তুতেঃ শর্করার সাথে ঈস্টের ফার্মেন্টেশন বিক্রিয়ায় ইথাইল অ্যালকোহল তৈরি হয়। দর্শনা চিনি কলে চিটাগুড়া থেকে এই প্রক্রিয়ায় অ্যালকোহল তৈরি করা হয়। একই প্রক্রিয়ায় বিউটানল, প্রপানল ইত্যাদিও প্রস্তুত করা হয়।
  • দুধ শিল্পেঃ দুধের সাথে Lactobacillus helveticus, Streptococcus lactis ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া মিশিয়ে ৩-৫ ঘন্টার মধ্যে 37-38°C তাপমাত্রায় দই তৈরি করা হয়। এটিও ব্যাকটেরিয়ার অবাত শ্বসনের ফল। পনির ও মাখন তৈরিতেও এই প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়।
  • আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্পেঃ অনেক আয়ুর্বেদ ওষুধ তৈরিতে বিভিন্ন ড্রাগের মিশ্রণের সাথে চিটাগুড়া দিয়ে পাত্র ঢেকে দেয়া হয় (এমনকি মাটির নিচে বেশ কিছুদিন রাখা হয়)। এতে চিটাগুড়া থেকে অ্যালকোহল তৈরি হয় যাতে বিভিন্ন ড্রাগের ওষুধিগুণ অ্যালকোহল কর্তৃক শোষিত হয়।
  • চা, তামাক ও কফি প্রক্রিয়াজতকরণেঃ Bacillus megatherium নামক ব্যাকটেরিয়া, চা ও তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণে ফার্মেন্টেশন পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয় এবং ফলে সবুজপাতা তাম্র বর্ণ প্রাপ্ত হয় এবং সুগন্ধযুক্ত হয়। কফি শিল্পেও এর প্রয়োগ আছে।
  • মাংস ও মাছ শিল্পেঃ বিভিন্ন ইস্ট ও কতিপয় ছত্রাক (Penicillium, Aspergillus), ব্যাকটেরিয়া (Pedicoccus cerevisiae, Bacillus sp), ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে মাংসজাত দ্রব্য, যেমন-দক্ষিণ
  • ভিটামিন তৈরিতেঃ থিয়ামিন ও রিবোফ্ল্যাবিন নামক ভিটামিন B₁ ও B, এই প্রক্রিয়ায় ঈস্টের সাহায্যে তৈরি করা হয়।
  • ভিনেগার উৎপাদনঃ গুড়ের মধ্যে ঈস্ট মিশিয়ে ইথাইল অ্যালকোহল উৎপন্ন হয়। এতে Acetobacter aceti নামক ব্যাকটেরিয়া দিয়ে জারণ ক্রিয়ায় অ্যাসিটিক অ্যাসিড বা ভিনেগার উৎপন্ন করা হয়।
  • কোমল পানীয় শিল্পেঃ বিভিন্ন প্রকার কোমল পানীয়ের প্রধান উপাদান সাইট্রিক অ্যাসিড গাঁজন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়।
  • চর্ম শিল্পেঃ চামড়া শিল্পে চামড়া থেকে পশুর লোম উঠিয়ে ফেলার জন্য এবং চর্বি ও অন্যান্য টিস্যু আলাদা করার জন্য বিশেষ ধরণের ব্যাকটেরিয়া (Bacillus subtilis) ব্যবহার করা হয়। এসব ব্যাকটেরিয়ার গাঁজনের ফলে চামড়া থেকে লোম, মেদটিস্যু ইত্যাদির অপসরণ ঘটে।

অবাত শ্বসন ও ফার্মেন্টেশনের মধ্যে পার্থক্য


পার্থক্যের বিষয়

অবাত শ্বসন

ফার্মেন্টেশন (গাঁজন)

১. ক্রিয়াস্থল

এটি জীবিত কোষের মধ্যে ঘটে।

এটি জীবিত কোষের বাইরে ঘটে।

২. কোথায় হয়

উচ্চ শ্রেণির উদ্ভিদে হয়।

শুধুমাত্র ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার মতো নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদে হয়।

৩. মাধ্যম

কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না।

তরল মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।

৪. বিক্রিয়ার স্থান

এতে কোষের মধ্যে সৃষ্ট বিভিন্ন এনজাইম সরাসরি বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।

এতে কোষের মধ্যে সৃষ্ট বিভিন্ন এনজাইম কোষের বাইরে নিঃসৃত হয়ে বিক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করে।

৫. গ্লুকোজ এর

উৎস 

দেহের অভ্যন্তরীণ গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়।

বাহ্যিক গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়।

৬. এনজাইম প্রকৃতি

কার্বোক্সিলেজ, ডিহাইড্রোজিনেজ প্রভৃতি এনজাইমের কার্যকারিতায় ঘটে।

জাইমেজ নামক এনজাইমের কার্যকারিতায় ঘটে।

৭. উৎপন্ন বস্তুর অবস্থান

এ প্রক্রিয়ায় কৌষের ভেতরে অ্যালকোহল ও CO₂ সঞ্চিত হয়।

এ প্রক্রিয়ায় কোষের বাইরে অ্যালকোহল ও CO₂ সঞ্চিত হয়।


কোন শ্বসন বিক্রিয়ার শ্বসনিক হার নির্ণয় কর


শ্বসনিক হার / কোশেন্ট (Respiratory quotient/ R.Q): শ্বসন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ যে পরিমাণ CO₂ ত্যাগ করে এবং যে পরিমাণ O₂ গ্রহণ করে তার অনুপাতকে শ্বসনিক হার (R.Q) বলে। বিভিন্ন শ্বাসনিক বস্তুর জন্য শ্বসনিক হার বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় শ্বসনিক বস্তু যদি গ্লুকোজ হয় তবে এটি সবাত শ্বসনের মাধ্যমে ৬ অণু CO₂ ত্যাগ করে এবং ৬ অণু O₂ গ্রহণ করে।
এক্ষেত্রে শ্বসন হার নির্ণয়ের জন্য নিম্নের সমীকরণ ব্যবহার করা হয়।

C6H12O6+6O2→6CO2+6H2O

কাজেই সবাত শ্বসনের (গ্লুকোজের) শ্বসনিক হার (R.Q) = নির্গত CO2 এর অণুর পরিমাণ / গৃহীত O₂ এর অণুর পরিমাণ
R.Q = 6CO2 / 6O₂ =6/6 =1
শ্বসন প্রক্রিয়ায় কার্বোহাইড্রেট, জৈব অ্যাসিড, চর্বি ও আমিষ শ্বসনিক বস্তু হিসেবে জারিত হয়। শ্বসনিক বস্তু ও শ্বসনের ধরণের উপর শ্বসন হার (R.Q) ভিন্ন ভিন্ন হতে দেখা যায়। যেমন-
ম্যালিক অ্যাসিডের R.Q = 4CO2 / 3O₂ = 4/3 = 1.33 
ওলিক অ্যাসিডের R.Q = 36CO₂ / 51O₂ = 36/51 = 0.71 
আমিযে O₂ এর পরিমাণ কম থাকে এবং আমিষ শ্বসনিক বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হলে এদের R.Q এর মান 1 এর কম হয়ে থাকে (0.83)।

শ্বসন প্রক্রিয়ার প্রভাবকসমূহঃ নিম্নলিখিত বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ প্রভাবকসমূহ শ্বসন ক্রিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

শ্বসনে বাহ্যিক প্রবাহ সমূহ কিভাবে শ্বসন ক্রিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করে


বাহ্যিক প্রভাবকসমূহঃ
  • ১. তাপমাত্রাঃ শ্বসন ক্রিয়া কতগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমষ্টি, আর এ রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর হার বিভিন্ন উৎসেচক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেহেতু উৎসেচকসমূহের কার্যকারিতা তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল সেহেতু তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি শ্বসনের হারকেও নিয়ন্ত্রিত করে। তাপমাত্রা 0°C থেকে 30°C পর্যন্ত বাড়ার সাথে সাথে শ্বসন হাও ক্রমাগত বাড়ে। 0°C শ্বসন হার খুবই কম থাকে। সাধারণত 20°C-35°C তাপমাত্রায় শ্বসন প্রক্রিয়া ভালোভাবে চলে। 45°C এর উপরের তাপমাত্রায় উৎসেচকসমূহের বিক্রিয়ার হার তথা শ্বসনের হার বেশ কমে যায়।
  • ২. অক্সিজেনঃ পাইরুভিক অ্যাসিডের পূর্ণাঙ্গ জারণের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন। সবাত শ্বসনে পাইরুণ্ডিক অ্যাসিড সম্পূর্ণ জারিত হয়ে CO₂ ও H₂O উৎপন্ন করে। অতএব কেবল সবাত শ্বসনেই অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে।
  • ৩ . পানিঃ কতগুলো বিক্রিয়ায় পানির প্রয়োজন হয়, অতএব প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ শ্বসন ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাকে।
  • ৪. আলোঃ শ্বসনকার্যে আলোর প্রয়োজন পড়ে না সত্যি কিন্তু দিনের বেলায় আলোর উপস্থিলিতে পত্ররন্ত্র খোলা থাকায় O₂ গ্রহণ ও CO₂ ত্যাগ করা সহজ হয় বলে শ্বসন হার একটু বেড়ে যায়।
  • ৫. কার্বন ডাই অক্সাইড এর ঘনত্বঃ বায়ুতে CO₂ এর ঘনত্ব বেড়ে গেলে শ্বসন হার কিঞ্চিৎ কমে যায়। 

শ্বসনে অভ্যন্তরীণ প্রবাহকসমূহ কিভাবে শ্বসন ক্রিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করে


অভ্যন্তরীণ প্রভাবকসমূহঃ
  • ১. জটিল খাদ্যদ্রব্যঃ সরল খাদ্য গ্লুকোজ শ্বসন ক্রিয়ার প্রধান শ্বসনিক বস্তু। বিভিন্ন বিক্রিয়ায় কোষস্থ জটিল খাদ্যই গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়। কাজেই জটিল খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ ও ধরণ শ্বসন প্রক্রিয়ার হারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
  • ২. উৎসেচকঃ শ্বসন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন বিক্রিয়ায় অসংখ্য উৎসেচক অংশগ্রহণ করে, তাদের উপস্থিতির উপরই সম্পূর্ণ শ্বসন প্রক্রিয়াটি নির্ভরশীল।
  • ৩. কোষের বয়সঃ যে কোষে প্রোটোপ্লাজম অধিক (অল্প বয়সের) সে সব কোষ শ্বসন হার অধিক হয়।
  • ৪. কোষস্থ অজৈব লবণঃ কোষে অজৈব লবণ অধিক পরিমাণে থাকলে শ্বসন হার বেড়ে যায়।
  • ৫. কোষ মধ্যস্থ পানিঃ কোষে প্রয়োজনীয় পানির অভাব হলে শ্বসন হার কমে যায়।
  • ৬. মাটিতে অজৈব লবণঃ মাটিতে NaCl, KCl, CaCl ও MgCl এর দ্রবণের সরবরাহ বৃদ্ধি ঘটিয়ে শ্বসন হার বৃদ্ধি করা যায়।
  • ৭. অন্যান্য প্রভাবকঃ আঘাতপ্রাপ্ত টিস্যুতে আঘাত নিরাময়ের জন্য কোষ বিভাজন দ্রুততর হয়, ফলে শ্বসন হার বেড়ে যায়। হাত দিয়ে পাতা মৃদু ঘষে দিলে শ্বসন হার বৃদ্ধি পায়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন