উদ্ভিদের পাতায় কিভাবে ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ সম্পন্ন হয়

ফটোসিনথেটিক ইউনিটের বৈশিষ্ট্য
উদ্ভিদের পাতায় কিভাবে ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ সম্পন্ন হয়


উদ্ভিদের পাতায় কিভাবে ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ সম্পন্ন হয়


  • ক্লোরোপ্লাস্টের থাইলাকয়েড মেমব্রেনে অবস্থিত ফটোসিস্টেমই ফটোসিনথেটিক ইউনিট হিসেবে কাজ করে।
  • এতে আলোর ফোটন শোষণ করার জন্য বিভিন্ন রঞ্জক অণু (৩০০-৪০০ অণু), সক্রিয় অণু ক্লোরোফিল-a; একগুচ্ছ বিশেষ ধরণের প্রোটিন, ইলেকট্রন গ্রহীতা ও ETC গুচ্ছাকারে পাশাপাশি একটি কার্যকরী ইউনিট হিসেবে অবস্থান করে।
  • এক সময় এই ইউনিটকে কোয়ান্টোসোম বলা হতো।
  • বর্তমানে জানা গেছে প্রতিটি কোয়ান্টোসোমে ২৩০টি ক্লোরোফিল (১৬০টি ক্লোরোফিল-৯, ৭০টি ক্লোরোফিল-b) ৪৮টি ক্যারোটিনয়েড, ৪৬টি কুইনোন, ১১৬টি ফসফোলিপিড, ৪৮টি সালফোলিপিড থাকে। 
  • এছাড়া কোয়ান্টোজোমে প্লাস্টোকুইনোন, সাইটোক্রোম-f, প্লাস্টোসায়ানিন, ফেরিডক্সিন, সাইটোক্রোম b₁ ইত্যাদি ইলেকট্রন বাহক থাকে।

ফটোসিস্টেমের অংশসমূহের বর্ণনা


ফটোসিস্টেমঃ এর তিনাটি অংশ। আলোক শোষণ অঞ্চল বা অ্যান্টেনা কমপ্লেক্স, বিক্রিয়া কেন্দ্র, ইলেকট্রন প্রবাহ তন্ত্র।
  • PS-II: এর আলোক শোষণ অঞ্চলে অ্যান্টেনা পিগমেন্ট (ক্লোরোফিল-b, B-কারোটিন) ও কোর পিগমেন্ট (ক্লোরোফিল-a 673) থাকে এবং বিক্রিয়া কেন্দ্রে প্রতিক্রিয় ক্লোরোফিল-a (P-680) ও কিছু প্রোটিন থাকে।
  • PS-I: এর আলোক শোষণ অঞ্চলে অ্যান্টেনা পিগমেন্ট (খুবই অল্প ক্লোরোফিল-b, ẞ-কারোটিন, জ্যান্থোফিল) ও কোর পিগমেন্ট (ক্লোরোফিল-a 683) থাকে এবং বিক্রিয়া কেন্দ্রে প্রতিক্রিয় ক্লোরোফিল-a (P-700) ও কিছু প্রোটিন থাকে।
Note:
কোর পিগমেন্ট এর শোষিত আলোকশক্তি বিক্রিয়া কেন্দ্র থেকে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত করে। (অ্যান্টেনা পিগমেন্ট এর শোষিত আলোকশক্তি কোর পিগমেন্টেই যায়)। ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হয়ে প্রাথমিক ইলেকট্রন গ্রহীতা কর্তৃক গৃহিত হয় এবং ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনের মাধ্যমে বাহিত হয়।

ইলেকট্রন প্রবাহতন্ত্র কিভাবে কাজ করে


ক্লোরোপ্লাস্টের প্রানার থাইলাকয়েড মেমব্রেন কিছু সংখ্যক ইলেকট্রন বাহক সুশৃঙ্খলভাবে সজ্জিত হয়ে ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বা ইলেকট্রন প্রবাহ তন্ত্র গঠন করে। এতে নিম্নলিখিত ও ধরণের বাহক পর্যায়ক্রমে অবস্থান করে-
১. ফিয়োফাইটিন (Pheophytin, Ph): এটি একটি রূপান্তরিত ক্লোরোফিল-a অণু। পরবর্তী বাহক প্লাস্টোকুইনোনের সাথে এটি সংযোগ সৃষ্টি করে। ক্লোরোফিল থেকে ম্যাগনেসিয়াম অণু বের হয়ে গেলে তাকে ফিয়োফাইটিন বলে।
২. প্লাস্টোকুইনোন (Plastoqunone, PQ): এক ধরণের লিপিড জাতীয় উপাদান যা প্রথম ইলেকট্রন বাহক হিসেবে সক্রিয় থেকে সাইটোক্রোমের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করে।
৩. সাইটোক্রোম (Cytochrome, Cyt.): এটি লৌহযুক্ত প্রোটিন যার লৌহ অণুটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে। সাইটোক্রোম পরবর্তী গৃহীত ইলেকট্রনটিকে হস্তান্তরের জন্য প্লাস্টোসায়ানিনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করে।
৪. প্লাস্টোসায়ানিন (Plastocyanin, PC): এটি এক ধরণের প্রোটিন। এর মধ্যে রয়েছে একটি কপার অণু যা ইলেকট্রন গ্রহণ করে এবং ফেরিডক্সিনের কাছে হস্তান্তর করে।
৫. ফেরিডক্সিন (Ferredoxin, Fd): লোহা ও সালফার অণুযুক্ত প্রোটিন যার লোহা ইলেকট্রন গ্রহণ ও স্থানান্তর করে।
৬. NADP-বিডারেজ (NADP-reductase): এটি এক ধরণের ফ্লাভোপ্রোটিন এবং সংযুক্ত কো-এনজাইম FAD (ফ্লাভিন অ্যাডিনিন ডাইনিউক্লিওটাইড)। এর ফ্লাভিন গ্রুপ ইলেকট্রন গ্রহীতা।

ফটোসিস্টেম-I ও ফটোসিস্টেম-II এর মধ্যে পার্থক্য

পার্থক্যের বিষয়

ফটোসিস্টেম-II

ফটোসিস্টেম-I

১. অবস্থান

ক্লোরোপ্লাস্টের গ্রানার থাইলাকয়েডের পর্দার ভিতরের দিকে অবস্থান করে।

ক্লোরোপ্লাস্টের স্ট্রোমা ল্যামিলি এবং গ্রানার থাইলাকয়েডের পর্দার বাইরের দিকে অবস্থিত।

২. ক্লোরোফিল

য বিক্রিয়াকেন্দ্রে ক্লোরোফিল-a-680 থাকে।

বিক্রিয়াকেন্দ্রে ক্লোরোফিল-a-700 থাকে।

৩. সম্পর্ক

কেবল মাত্র অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশনের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

চক্রীয় এবং অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশনের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

৪. ক্লোরোফিল-a

অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে ক্লোরোফিল-a থাকে।

অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে ক্লোরোফিল-a থাকে।

৫. NADP

NADP বিজারণে প্রোটন প্রদান করে।

NADP বিজারণে ইলেকট্রন প্রদান করে।

৬. ঘাটতি ইলেকট্রন

পানি থেকে এসে পূরণ হয়।

PS-II থেকে এসে পূরণ হয়।

৭. প্রান্তীয় ইলেকট্রন গ্রাহক

প্লাস্টোকুইনোন (PQ) প্রান্তীয় ইলেকট্রন গ্রাহক হিসেবে কাজ করে।

ফেরিডক্সিন (Fd) প্রান্তীয় ইলেকট্রন গ্রাহক হিসেবে কাজ করে।

৮.পানির আলোক বিশ্লেষণ

ঘটে

ঘটে না

৯.ক্লোরোফিল:ক্যারোটিনয়েড

5:1

25:1

১০ . ক্যারোটিনয়েডস

জ্যান্থোফিল বেশি থাকে।

ক্যারোটিন বেশি থাকে।


সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতির প্রকারভেদ ও চক্রীয় অচক্রীয় ফটোফসফরাইলেশন কিভাবে সংঘটিত হয়


বিজ্ঞানী ব্ল‍্যাকম্যান ১৯০৫ সালে সালোকসংশ্লেষণের সামগ্রিক পদ্ধতিটিকে দুটো ভাগে ভাগ করেন।
১. আলোক নির্ভর অধ্যায় (থাইলাকয়েড)
২. আলোক নিরপেক্ষ পর্যায় (স্ট্রোমা)
১. আলোক নির্ভর অধ্যায়ঃ
চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশনঃ যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় PS-I হতে উৎক্ষিপ্ত ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে স্থানান্তরের সময় ATP উৎপাদন করে পুনরায় PS-I এ ফিরে আসে তাকে চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
  • কোর পিগমেন্ট (Chl-a 683) 683nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি শোষণ করে শক্তি প্রাপ্ত হয়। এছাড়া অ্যান্টেনা পিগমেন্টও (ক্যারোটিন ও জ্যান্থোফিল) কিছু পরিমাণ আলোকশক্তি শোষণ করে কোর পিগমেন্টে দিয়ে দেয়।
  • এ প্রক্রিয়ায় কেবল PS-I অংশগ্রহণ করে।
  • কোর পিগমেন্ট (Chl-a 683) থেকে শোষিত আলোকশক্তি বিক্রিয়া কেন্দ্রের প্রতিক্রিয় রঞ্জক ক্লোরোফিল-a (P-700)-তে স্থানান্তরিত হয়।
  • বিক্রিয়া কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপিত ইলেকট্রন Fd কর্তৃক গৃহীত হয়।
  • ইলেকট্রন Fd থেকে যথাক্রমে Cyt. b, PQ, Cyt, f, PC হয়ে আবার PS-I এর বিক্রিয়া কেন্দ্রে ফিরে আসে।
  • PQ থেকে ইলেকট্রন Cyt. f এ স্থানান্তরের সময় মুক্ত শক্তির ADP সহযোগে এর সাথে Pi যুক্ত হয়ে ATP তৈরি হয়।
Note:
  • আদি ব্যাকটেরিয়াতে শুধু চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশনই ঘটে।
  • সায়ানো ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ও সবুজ উদ্ভিদে সাধারণত NADP সরবরাহ বন্ধ হলে চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন হয়।
  • পানি সরবরাহ বন্ধ হলে চক্রীয় প্রক্রিয়া ঘটে।
  • প্রয়োজনে উভয় প্রক্রিয়া একই সঙ্গে চলতে পারে।
  • কেবল চক্রীয় প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ATP দিয়ে উচ্চ শ্রেণির উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় শর্করা তৈরি সম্ভব নয়।
অচক্রীয় ফটোফসফোরাইজোমলাঃ যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় PS-II হতে উৎক্ষিপ্ত ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে স্থানান্তরের সময় ATP উৎপাদন করে পুনরায় PS-II এ ফিরে না এসে PS-I স্থানান্তরিত হয় তাকে অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
  • এ প্রক্রিয়ায় PS-II ও PS-I উভয়ই অংশগ্রহণ করে।
  • PS-II এর কোর পিগমেন্ট (Chl-a 673) 673nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি শোষণ করে শক্তি প্রাপ্ত হয়। এছাড়া PS-II এর অ্যান্টেনা পিগমেন্টও (Chl-b, ক্যারোটিন) কিছু পরিমাণ আলোকশক্তি শোষণ করে পরবর্তীতে কোর পিগমেন্টে (Chl-a 673) দিয়ে দেয়।
  • কোর পিগমেন্ট (Chl-a 673) থেকে শোষিত আলোকশক্তি বিক্রিয়া কেন্দ্রের প্রতিক্রিয় রঞ্জক ক্লোরোফিল-a (P-680)-তে স্থানান্তররিত হয়।
  • ফলে বিক্রিয়া কেন্দ্র (P-680) থেকে উৎক্ষিপ্ত ইলেকট্রন Ph কর্তৃক গৃহীত হয় এবং PQ এ স্থানান্তরিত হয়। PQ থেকে ইলেকট্রন Cyt. f, PC হয়ে PS-I এর বিক্রিয়া কেন্দ্রে প্রবেশ করে।
  • কেননা একই সময়ে PS-I এর বিক্রিয়া কেন্দ্রে ইলেকট্রন ঘাটতি হয়।
  • কারণ PS-I এর কোর পিগমেন্ট (Chl-a 683) 683nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি শোষণ করে শক্তি প্রাপ্ত হয়।
  • এছাড়া PS-I এর অ্যান্টেনা পিগমেন্টও (ক্যারোটিন ও জ্যান্থোফিল) কিছু পরিমাণ আলোকশক্তি শোষণ করে পরবর্তীতে কোর পিগমেন্টে (Chl-a 683) দিয়ে দেয়।
  • PS-I এর কোর পিগমেন্ট (Chl-a 683) থেকে শোষিত আলোকশক্তি বিক্রিয়া কেন্দ্রের প্রতিক্রিয় রঞ্জক ক্লোরোফিল-a (P-700)-তে স্থানান্তররিত হয়।
  • ফলে বিক্রিয়া কেন্দ্র থেকে উৎক্ষিপ্ত ইলেকট্রন Fd কর্তৃক গৃহীত হয়।
  • Fd হতে ২টি ইলেকট্রন গ্রহণ করে NADP-reductase। NADP Reductase দুটি ইলেকট্রন (P700 বিক্রিয়া কেন্দ্র হতে উৎক্ষিপ্ত) এবং দুটি প্রোটন (পানির ভাঙন হতে সৃষ্ট) সহযোগে NADP কে বিজারিত করে NADPH + H তৈরি করে।
  • ATP NADPH + H'কে আত্তীকরণ শক্তি বলে যা শর্করা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
  • PS-II এর বিক্রিয়া কেন্দ্রের (P-680) ইলেকট্রন ঘাটতি পূরণ হয় পানির সালোক বিভাজনের মাধ্যমে।
PS-II-তে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে Mgt ও CT এর সাহায্যে পানি ভেঙ্গে 1/2 O 2H এবং 2e উৎপন্ন হয়। একে ফটোলাইসিস বলে।

চক্রীয় ফটোফসফরাইলেশন ও অচক্রীয় ফটোফসফরাইলেশন এর মধ্যে পার্থক্য


পার্থক্যের বিষয়

চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন

অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন 

১. উৎক্ষিপ্ত ইলেকট্রন

PS-I হতে উৎক্ষিপ্ত ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে বাহিত হয়ে পুনরায় PS-I এ ফিরে আসে।

PS-II হতে উৎক্ষিপ্ত ইলেকট্রন পুনরায় PS-II তে ফিরে আসে না। 

২. ফটোসিস্টেম

কেবলমাত্র PS-I অংশগ্রহণ করে।

PS-I ও PS-II উভয়ই অংশগ্রহণ করে।

৩. পানির প্রয়োজন

পানির প্রয়োজন হয় না।

পানির প্রয়োজন হয়। কারণ পানির ইলেকট্রন ও প্রোটন এ প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। 

৪. O₂ উৎপন্ন

কোনো O₂ উৎপন্ন হয় না কারণ এ প্রক্রিয়ায় কোনো পানি ব্যবহৃত হয় না।

পানির ভাঙনের ফলে O₂ উৎপন্ন হয় যা পরে বায়ুতে নির্গত হয়। 

৫. NADP এর জারণ

কোনো NADP বিজারিত হয় না।

এক অণু NADP বিজারিত হয়ে এক অণু NADPH+H+  করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন