মানসিক রোগের ১৪টি লক্ষণসমূহ - মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়
মানসিক রোগের ১৪টি লক্ষণসমূহ এবং মানসিক রোগী চেনার ৭টি উপায় সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের ১০টি উপায়এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় এবং মানসিক রোগের তালিকা। এছাড়া আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইলো।
মানসিক রোগ নিয়ে কিছু তথ্য ও পরামর্শ
- ১। মানসিক রোগী মানেই ভয়ংকর, আক্রমনাত্মক হয় না, শুধুমাত্র গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত অল্পসংখ্যক রোগী আক্রমনাত্মক হয়।
- ২। মানসিক রোগী মানেই 'পাগল' না। এটা এক ধরনের অসুস্থতা যা অন্যান্য শারীরিক রোগের মতই চিকিৎসাযোগ্য।
- ৩। অনেকেই মনে করে মানসিক রোগ কখনোই ভালো হয় না কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে রোগী যদি ডাক্তারের পরামর্শ মত ঔষধ খায় ও প্রয়োজনীয় উপদেশ মেনে চলে এবং পরিবারের সহযোগিতা পায় তাহলে অনেক রোগী সুস্থ হয়ে যায়।
- ৪। মানসিক রোগের ঔষধ 'ভীষণ কড়া আর ভয়ংকর, অনেক সাইড ইফেক্ট' কিংবা মানসিক রোগের ঔষধ মাত্রই 'ঘুমের ঔষধ'- এগুলো ভুল ধারণা। শুধু মানসিক রোগের না, সব ঔষধেরই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে।
- ৫। মানসিক রোগের ঔষধ খেতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে। বন্ধও করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো। চিকিৎসক ছাড়া অন্য কারও কথায় বা পরামর্শে ঔষধ বন্ধ করা বিপদের কারণ হতে পারে।
- ৬। অনেকে মনে করে ঔষধ খাওয়া মাত্রই বা ঔষধ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুস্থ হয়ে যাবেন, কিন্তু মানসিক রোগের বেশির ভাগ ঔষধের কার্যকারিতা পেতে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়।
- ৭। মানসিক অসুস্থতা কিছুই না, এটা এক ধরনের ঢং বা অভিনয়, মনোযোগ আকৃষ্ট করার কৌশল। কিন্তু এটা কোন ঢং নয়। এটা শারীরিক অন্যান্য রোগের মতোই অসুস্থতা। আর কেউই স্বেচ্ছায় অসুস্থ হয় না।
- ৮। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাপ্ত বয়স্কের মধ্যে ১৬.৮% মানুষ কোন না কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত। শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৩.৬%।
- ৯। প্রতিটি মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আছে। অপচিকিৎসা ও কুসংস্কার মানসিক রোগের ভোগান্তি বাড়ায়।
- ১০। মানসিক রোগ এবং চিকিৎসা নিয়ে অহেতুক ভীতি ছড়াবেন না। এ ধরনের রোগ বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণযোগ্য, চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার।
মানসিক রোগের ১৪টি লক্ষণসমূহ
- মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরানো, মাথা গরম হয়ে যাওয়া, শরীর জ্বালাপোড়া করা।
- অতিরিক্ত টেনশন, বুক ধড়ফড় করা, সাথে শ্বাসবন্ধ হওয়ার অনুভূতি, হাত-পা ঝিমঝিম ও ঠান্ডা হয়ে অজ্ঞান অনুভূতি হওয়া, যাকে প্যানিক এ্যাটাক বলে।
- বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন, যেমন মন খারাপ বা বিরক্ত লাগা, হতাশা, অতিরিক্ত দূর্বলতা, ঘুম কম হওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা, ভুলে যাওয়া, আত্মবিশ্বাসহীনতা।
- ঘুমের সমস্যা, ইনসমনিয়া, নাইট মেয়ার (দুঃস্বপ্ন), নাইট টেরর, স্লীপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা।
- ওসিডি বা শুচিবাই, যেমন অতিরিক্ত ধোয়া মোছা করা, বার বার চেক করা, একই কাজ বার বার করা, কোনো কাজ হয়েছে কিনা সন্দেহ- যেমন প্রস্রাব করে পরিস্কার হয়েছে কিনা ইত্যাদি।
- ভীতি/ফোবিয়া যেমন মৃত্যুভয়, পরীক্ষা ভীতি, সামাজিক ভীতি বা সোশ্যাল এবং এংজাইটি ইত্যাদি।
- ব্যক্তিত্ব জনিত সমস্যা।
- আত্মহত্যার প্রবণতা।
- অকারণে রাগ করা, অতিরিক্ত রাগ, নিজেকে আঘাত করা।
- মানসিক চাপ বা স্ট্রেস, কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস, রিলেশনশিপ সমস্যা।
- মহিলা ও পুরুষদের যৌন সমস্যা, মাদকাসক্তি, ইন্টারনেট, গেম ও পর্ণ এডিকশন।
- সিজোফ্রেনিয়া, যেমন- সন্দেহ প্রবণতা, কানে গায়েবী আওয়াজ শোনা, একা একা কথা বলা, অসংলগ্ন কথা বলা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, নিজের যত্ন না নেওয়া, আক্রমণাত্মক ব্যবহার।
- বাইপোলার এবং ম্যানিয়া যেমন- অতিরিক্ত কথা বলা, রাগ করা, অতিরিক্ত খরচ করা, নিজেকে বেশি জাহির করা।
- হিস্টেরিয়া অর্থাৎ মানসিক সমস্যার কারণে খিচুনী, আলগা দোষ বা উপরি দোষ, হঠাৎ কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শরীরের কোন অংশ অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
মানসিক রোগী চেনার ৭টি উপায়
মানসিক রোগ চিহ্নিত করার জন্য কিছু সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে যা একটি মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছে কিনা তা নির্দেশ করতে পারে। তবে, এটি গুরুত্বপূর্ণ যে সঠিক নির্ণয়ের জন্য একটি মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। নিচে কিছু সাধারণ লক্ষণ এবং উপসর্গ তুলে ধরা হলোঃ
আরো পড়ুনঃ ব্রেইনকে প্রখর রাখতে ৮টি অভ্যাস
- হঠাৎ করে মেজাজের ওঠা-নামা, অযৌক্তিক রাগ, অতিরিক্ত দুঃখ।
- সামাজিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়া।
- দীর্ঘ সময় ধরে দুঃখিত থাকা, হতাশা। অতিরিক্ত উদ্বেগ বা আতঙ্ক।
- অতিরিক্ত ঘুমানো বা ঘুম না হওয়া। খাওয়ার আগ্রহ কমে যাওয়া বা অত্যধিক খাওয়া।
- সহজে বিভ্রান্ত হওয়া, কোন কিছুতে মনোযোগ রাখতে সমস্যা। অযৌক্তিক চিন্তা বা ভুল ধারণা।
- প্রিয় কাজগুলিতে আগ্রহ হারানো।
- সংবেদনশীলতা ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা এমন কিছু দেখা বা শোনা যা বাস্তবে নেই। বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা, হ্যালুসিনেশন বা ভুল ধারণা।
মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়
যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ মানসিক রোগ লক্ষণগুলি দেখা যায়, তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও সহায়তা দিতে সক্ষম হবেন। মানসিক রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা ও সহায়তার মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করা সম্ভব।
মানসিক রোগের তালিকা ও লক্ষণ
মানসিক রোগ বিভিন্ন ধরণের হতে পারে এবং তাদের লক্ষণ ও উপসর্গও বিভিন্ন হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ মানসিক রোগের তালিকা দেওয়া হলোঃ
ডিপ্রেশন (বিষণ্নতা)
প্রধান লক্ষণঃ দীর্ঘমেয়াদী দুঃখ, আশা হারানো, আগ্রহের অভাব, ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা, খাওয়ার সমস্য, আত্মহানির চিন্তা।
অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার (উদ্বেগজনিত রোগ)
প্রধান লক্ষণঃ অতিরিক্ত উদ্বেগ, আতঙ্ক, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, ঘাম হওয়া, কাঁপুনি, মাথা ঘোরা।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার (দ্বিমেরু মানসিক রোগ)
প্রধান লক্ষণঃ মেজাজের চরম পরিবর্তন, কখনও অত্যধিক উচ্ছ্বাস (মানিয়া), কখনও অত্যধিক বিষণ্নতা।
স্কিজোফ্রেনিয়া (মনোবৈকল্য)
প্রধান লক্ষণঃ হ্যালুসিনেশন, ভুল ধারণা, অস্বাভাবিক চিন্তা, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)
প্রধান লক্ষণঃ অতীতের কোন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি চিন্তা, দুঃস্বপ্ন, আতঙ্ক, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
ইটিং ডিজঅর্ডার (খাওয়ার অভ্যাসজনিত রোগ)
প্রধান লক্ষণঃ অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা, বুলিমিয়া নারভোসা, ওভারইটিং, খাওয়া নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা।
পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (ব্যক্তিত্বজনিত রোগ)
প্রধান লক্ষণঃ দীর্ঘস্থায়ী এবং প্যাটার্নযুক্ত আচরণগত সমস্যা, যা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করে। যেমন বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার (এএসডি)
প্রধান লক্ষণঃ সামাজিক যোগাযোগে সমস্যা, পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ, সীমিত আগ্রহ।
ডিমেনশিয়া
প্রধান লক্ষণঃ স্মৃতিভ্রংশ, চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন।
সাইকোসিস
প্রধান লক্ষণঃ বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা, হ্যালুসিনেশন, ভুল ধারণা।
সামাজিক উদ্বেগ ডিজঅর্ডার
প্রধান লক্ষণঃ সামাজিক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ভয় বা উদ্বেগ, লজ্জাবোধ, অন্যদের দ্বারা বিচারিত হওয়ার ভয়।
প্যানিক ডিজঅর্ডার
প্রধান লক্ষণঃ আকস্মিক আতঙ্কের অনুভূতি, দ্রুত হৃদস্পন্দন, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা।
অ্যাটাচমেন্ট ডিজঅর্ডার
প্রধান লক্ষণঃ শিশুদের ক্ষেত্রে মূলত দেখা যায়, যেখানে তারা নিরাপদ সম্পর্ক গড়তে সমস্যায় পড়ে।
প্রত্যেকটি মানসিক রোগের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা এবং পরামর্শ প্রয়োজন। একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্যে এই রোগগুলি সঠিকভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা সম্ভব।