বেগুন চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সুষম ব্যবহার
বেগুন চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সুষম ব্যবহার এবং বেগুনের চারা লাগানোর নিয়ম এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এই আর্টিকেলটি করতে পারেন।
এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি বেগুনের চারা লাগানোর নিয়ম এবং বেগুনের রোগ ও তার প্রতিকার কৌশল। এছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইল।
উচ্চ ফলনশীল বেগুন চাষের উন্নত পদ্ধতি
আমাদের দেশের যেসব ফসল আবাদ হয়ে থাকে তার মধ্যে সবজি ফসল হিসেবে বেগুনের নাম সর্বাগ্রে আসে। বেগুনে সহজপাচ্য প্রোটিন, খনিজ, ভিটামিন- এ, থায়ামিন, রাইবোফ্লোবিন, নিকোটোনিক এসিড এবং ভিটামিন-সি রয়েছে। নিম্নে বেগুনের চাষাবাদ পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো
বেগুন চাষের জন্য মাটি নির্বাচন
পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত দো-আঁশ মাটি বেগুন চাষের জন্য সবচেয়ে উত্তম। খরিফ মৌসুমে এঁটেল মাটি বর্জন করতে হবে।
বেগুনের জাত পরিচিতি
ক) রবি মৌসুম- ইসলামপুরী, কাজি বেগুন, রাখাইন (স্থানীয় নাম), খটখটিয়া, বারি বেগুন-৪।
খ) খরিফ মৌসুম- সিংনাথ, উত্তরা।
গ) সারা বছর- বারি বেগুন-১, বারি বেগুন-৫ (নয়নতারা)।
বেগুন রোপণের সময়
গ্রীষ্মকালীন ফসল মাঘ-ফাল্গুন মাসে, বর্ষাকালীন ফসল বৈশাখ মাসে এবং শীতকালীন ফসলের জন্য ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চারা রোপণ করতে হয়।
বীজের হার
- প্রতি ৩ বর্গমিটার বীজতলার জন্য ১৪-১৬ গ্রাম বীজ প্রয়োজন। প্রতি কেজি বীজ শোধনের জন্য বপনের ৬ ঘণ্টা আগে ২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ ব্যবহার
- বেগুনের চারা রোপণ দূরত্ব
- সাধারণত বেড আকারে বেগুন চাষ উত্তম।
- বেডের আকার রাখতে হবেঃ প্রস্থ- ১০০ সে.মি. (দুই সারি)
- দৈর্ঘ্য- জমির দৈর্ঘ্যের অনুরূপ।
- দূরত্ব হবেঃ এক সারির জন্য ৭৫০৫০ সে.মি.
- দুই সারির জন্য ৬০X৫০ সে.মি.।
- বেডের নালার আকারঃ গ্রস্থ ৩০ সে.মি.।
- গভীরতা- ২০ সে.মি.।
বেগুনের চারা লাগানোর নিয়ম
চারা গাছে যখন ৫/৬ টি পাতা হবে তখন রোপণ উপযোগী হবে। চারা তোলার ৩০ মিনিট পূর্বে বীজতলায় পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে, যাতে চারা তোলার সময় শিকড় ছিড়ে না যায়। চারা বিকেলে লাগাতে হবে। লাগানোর পরে চারার গোড়ার চারপাশে ৭.৫ সে.মি. দূর দিয়ে আঙ্গুলের সাহায্যে ৫ সে.মি. গভীর গোলাকার নালা তৈরি করতে হবে। এতে কাটুই পোকার আক্রমণ কমে যায়। চারা লাগানোর পর বড় পাতা অথবা কলা গাছের খোল কেটে চারা ঢেকে দেয়া উচিত। খোলের দৈর্ঘ্য ২০-২৫ সে.মি. হবে। কোন স্থানে চারা মারা গেলে ৭-১০ দিনের মধ্যে অন্য একটি চারা লাগাতে হবে।
বেগুন চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সুষম ব্যবহার
বেগুন ক্ষেতে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগের ফলে গাছের বৃদ্ধি ভাল হয়। ফলন বেশি হয় এবং রোগ পোকার আক্রমণ কম হয়। প্রতি হেক্টরে সারের পরিমাণ-
- গোবর ১৫ টন
- ইউরিয়া ৩৭০-৩৮০ কেজি
- টিএসপি ১৪৫-১৫৫ কেজি
- এমপি ২৪০-২৬০ কেজি
সম্পূর্ণ গোবর ও টিএসপি এবং ইউরিয়া ও এমপি-এর অর্ধেক জমি চাষের সময় ও বাকি অর্ধেক গর্তে হার মতো দিতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমপি সার চারা রোপণের পর গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে ২-৩ কিস্তিতে চারার গোড়ায় নির্ধারিত দূরত্বে ব্যবহার করতে হবে
বেগুন ক্ষেতের পরিচর্যা
বেগুন ক্ষেতে ভাল ফলন পেতে হলে জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত রাখতে হবে। প্রয়োজন মাফিক সেচ দিতে হবে। বেগুন ক্ষেতে ফসলের পোকার সমন্বিত প্রতিকার বা দমনঃ
- ১। যে জাতে পোকার আক্রমণ কম হয় সে সমস্ত জাত চাষ করা উচিত।
- ২। সবল সতেজ চারা রোপণ এবং পোকায় আক্রান্ত চারা রোপণ সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে।
- ৩। ২/১ দিন পর পর ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং ক্ষেতের আক্রান্ত পাতা, ডগা, ফল, মাটিতে পুঁতে বা আগুনে পুড়ে নষ্ট করতে হবে।
- ৪। প্রতি বছর একই জমিতে বেগুনের চাষ করলে ঐ জমিতে পোকার জীবনের বিভিন্ন স্তর থেকে যায় এবং এ পোকা দমনে কষ্ট হয়। তাই ২-১ বছর অন্য ফসল চাষ করে এর আক্রমণ অনেকটা কমানো যায়।
- ৫। ক্ষেতে শুকনা পাতা, গাছের গায়ে লেগে থাকা ঝরা পাতা, আবর্জনা বা ঘাস সরিয়ে ফেলতে হবে।
- ৬। বেগুন ক্ষেতে নানা প্রকার উপকারী পোকামাকড় রয়েছে। এরা ক্ষতিকর পোকার পূর্ণ বয়স্ক লার্ভা অথবা ডিম বিভিন্ন স্তরে ধ্বংস করে থাকে। যথেচ্ছভাবে কীটনাশক ব্যবহারে এসব উপকারী পোকা বা প্রাকৃতিক শত্রু মারা পড়ে। ফলে ক্ষতিকর পোকা বৃদ্ধি পায়। তাই জরিপ বা বিচার বিবেচনা না করে কীটনাশক ব্যবহার সম্পূর্ণ অনুচিত।
- ৭। শুধুমাত্র ইউরিয়া সার ব্যবহারে গাছ নরম হয়। ফলন কম হয় তাই অনুমোদিত মাত্রায় সুষম আকারে বেগুন ক্ষেতে সার ব্যবহার করা প্রয়োজন।
- ৮। উপরে উলে-খিতভাবে আক্রমণের পর যদি পোকার আক্রমণের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় সে ক্ষেত্রে জরিপ সাপেক্ষে প্রয়োজনে অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায়, সঠিক সময়, সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে।
বেগুন ফসল সংগ্রহ
বীজ বপনের ৩ থেকে ৪ মাস অর্থাৎ ৯০ থেকে ১২০ দিন পর ফসল সংগ্রহ শুরু হয়। ৭-১০ দিন পর পর উপযোগী ফসল ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এক মৌসুমে হেক্টরপ্রতি প্রায় ৭০-৮০ টন ফলন পাওয়া যায়।
বেগুনের রোগ ও তার প্রতিকার কৌশল
বেগুন বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান সবজি। আলুর পরেই এর স্থান দেশের সর্বত্রই এর চাষ হয় এবং সব শ্রেণীর লোকের কাছে জনপ্রিয়। রোগবালাই বেগুন উৎপাদনের একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। বেগুনের কয়েকটি মারাত্মক রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হলো।
বেগুনের গোড়া ও মূল পচা রোগ
রোগের লক্ষণঃ পিথিয়াম, রাইজোকটোনিয়া, ফাইটোপতোরা ও অন্যান্য ছত্রাক দ্বারা এই রোগটি নার্সারিতে হয়ে থাকে। এটি একটি মারাত্মক রোগ। চারার হাইপোকোটাইল, কাণ্ডের গোড়া ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্রধান মূলে আক্রমণ করে। আক্রান্ত চারার কাণ্ডের গোড়ার অংশে ফ্যাকাশে সবুজ ও বাদামি দাগ দেখা যায়। আক্রান্ত অংশের কোষসমূহ পচে যায় ও চারা মারা যায়।
প্রতিকার বা দমন
- ১। এ রোগ দমনের জন্য বীজ বপনের ২ সপ্তাহ পূর্বে ফরমারডিহাইড দ্বারা বীজতলা শোধন করতে হয়,
- ২। প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ দ্বারা বীজ শোধন করে বপন করতে হবে,
- ৩। বীজ ৫২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় গরম পানিতে ৩০ মিনিট রেখে শোধন করে নিয়ে বপন করতে হবে।
বেগুনের ফল ও কাণ্ড পচা রোগ
রোগের লক্ষণঃ ফোমপসিস ভেক্সান্স নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হলে চারা গাছ মাটিতে নেতিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে বাকল খসে পড়ে এবং কাণ্ডের কোষ অনাবৃত অবস্থায় দেখা যায়। গাছের পাতা যে কোন সময় আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগ ফলেও আক্রমণ করে এবং কালো ক্ষতের সৃষ্টি করে ফল পচিয়ে দেয়।
প্রতিকার বা দমন
- ১। সুস্থ ও নীরোগ বেগুন হতে বীজ সংগ্রহ করে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- ২। কালো ও কুঁচকানো বীজ ব্যবহার করা উচিত।
- ৩। প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ দ্বারা শোধন করে বীজ বপন করতে হবে।
- ৪। বেগুন পরিবারের সবজি বাদ দিয়ে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- ৫। এই ছত্রাকটি আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশসমূহে বছরের পর বছর বেঁচে থাকে, তাই আক্রান্ত গাছ। ঝরে পরা পাতা, ডালপালা একত্র করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
- ৬। রোভরাল প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম বা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি লিটার মিলিয়ে জমির সব গাছে স্প্রে করতে হবে।