আনারস গাছের জলসেচ - আনারসের চারা রোপণ এর চাষ পদ্ধতি

আনারস গাছের জলসেচ এবং আনারসের অন্তর্বর্তী পরিচর্যা এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এই আর্টিকেলটি পড়তে হবে।
আনারসের চারা রোপণ এর চাষ পদ্ধতি
এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি আনারসের চারা রোপণ এর চাষ পদ্ধতি এবং আনারস চাষের জন্য কেমন মাটি প্রয়োজন। এছাড়া আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়া অনুরোধ রইলো।

আনারস (Pineapple) বৈজ্ঞানিক নাম (Scientific name)


Ananas comosus Merr.
Syn: Ananas sativus Schutt.
গোত্রঃ (Family or Natural order): Bromeliaceae.

ভূমিকা


দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল এ ফলের আদি জন্মস্থান। ১৫৪৮ খ্রীষ্টাব্দে আনারস ভারতে প্রবেশ লাভ করেছে। প্রধানতঃ আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কেরালা, গোয়া, উড়িষ্যা, কর্নাটক ও পূর্বোত্তর রাজ্যে আনারস চাষ হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় এবং দক্ষিণ বঙ্গের ২৪ পরগণা জেলায় (বারুইপুর ও জয়নগর) প্রায় ৭০০০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়। বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলা (ছাতক), কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে যথেষ্ট পরিমাণ আনারসের চাষ হতে দেখা যায়।

কোন জলবায়ু আনারস ভালো চাষ করা হয়


আনারস প্রকৃত পক্ষে ক্রান্তীয় ফল। কিন্তু উপক্রান্তীয় জলবায়ুতেও আনারস জন্মাতে পারে। সমতলভূমি থেকে শুরু করে ৯০০ মিটার উঁচু পাহাড়ী এলাকাতে আনারস ভালভাবে জন্মায়। আনারসের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হ'ল ১৫-৫০-৩২.৫° সেলসিয়স এবং বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫০ সেমি। এ ফল তুষারপাত সহ্য করতে পারে না। অধিক তাপমাত্রা, অত্যুজ্জ্বল সূর্যাকিরণ যুক্ত এলাকায় আনারস চাষ করতে হলে আনারস গাছের জন্যে অল্প ছায়াময় জায়গা দরকার। অধিক ছায়া এ ফসলের পক্ষে ক্ষতিকারক। তরাই ও ডুয়ার্সের আর্দ্র জলবায়ুতে আনারস ভাল হয়।

আনারস চাষের জন্য কেমন মাটি প্রয়োজন


উঁচু ও জল দাঁড়ায় না উর্বর দোআঁশ ও বেলে-দোআঁশ মাটি বিশেষ উপযোগী। মাটির পি-এইচ ৫-৫-৬-০ হওয়া উচিত। ৫-৬ বার আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি কর্ষণ ও মই দিয়ে মাটি ভালভাবে তৈরী করে নিতে হবে। জমি তৈরীর সময় একরে ১০ টন হিসাবে গোবর সার বা আবর্জনা সার প্রয়োগ করতে হবে।

আনারসের চারারোপণ এর চাষ পদ্ধতি


জমিতে প্রয়োজন অনুযায়ী জলনিকাশের নালী তৈরী করে জমিকে কয়েকটি প্লটে ভাগ করে নিতে হবে। তারপর ছোট বড় চারা বাছাই করে আলাদাভাবে বসাতে হবে। কারণ ছোট বড় চারা এক সঙ্গে লাগালে ছোট চারাগুলো বড় চারার সাথে বাড়তে পারবে না। জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে এক ফুট (৩০ সেমি) চওড়া, এক ফুট লম্বা ও এক ফুট গভীর গর্ত করে কিছু আবর্জনা বা গোবর সার মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করে রাখতে হবে। 
সাধারণতঃ বর্ষাকাল বাদে বছরের সব সময়ই আনারসের চারা লাগান যেতে পারে। তবে বর্ষার শেষ থেকে চারা বসানোই ভাল। উত্তরবঙ্গে কার্তিক-অগ্রহায়ণ ও দক্ষিণবঙ্গে আশ্বিন-কার্তিক মাস চারা বসানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় জমিতে যথেষ্ট রস থাকে অথচ জল জমে চারা পচে যাওয়ার ভয় থাকে না। চারার গোড়া ২/৩ ইঞ্চি মাটির মধ্যে থাকবে। 

কিউ (Kew) জাত সাধারণতঃ "জোড়া সারি” (Double row) এবং কুইন (Queen) ও মরিসাস (Mauritius) জাতের চারা 'একক সারি' (Single row) পদ্ধতিতে লাগানো হয়। জোড়া সারি পদ্ধতিতে ২ ফুট (৬০ সেমি) অন্তর সারি করে সারিতে ১১/২ ফুট (৪৫ সেমি) দূরে দূরে চারা লাগাতে হবে। দুটো জোড়া সারির মাঝখানে ৪ ফুট (১২০ সেমি) দূরত্ব রাখতে হবে। 

একক সারি পদ্ধতিতে ৩×৩ ফুট (৯০০ ৯০ সেমি) বা ৩০২২ ফুট (৯০ × ৭৫ সেমি) বা ২২ × ২১/২ ফুট (৭৫ × ৭৫ সেমি) দূরত্বে চারা লাগান যায়। ঘনভাবেও অর্থাৎ ২ × ২ ফুট (৬০ × ৬০ সেমি) দূরত্বে চারা লাগান যায়। চারাগুলি পরস্পরের বিপরীতে না বসিয়ে কোণাকুণিভাবে বসান উচিত।

আনারস চাষের জন্য গাছ প্রতি সার প্রয়োগ করা দরকার


ভাল ফলন পাওয়ার জন্যে আনারসে পরিমিত পরিমাণে সার প্রয়োগ করা দরকার। প্রতি বছর প্রতিটি আনারস গাছে আনুমানিক ১০ গ্রাম নাইট্রোজেন, ৬ গ্রাম ফসফরাস ও ১০ গ্রাম পটাসিয়াম প্রয়োগ করা দরকার। এই হিসাবে প্রতি হাজার গাছে প্রতি বছর নিম্নলিখিত পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে। যথাঃ
  • অ্যামোনিয়াম সালফেটঃ ৫০ কেজি।
  • ইউরিয়াঃ ২৩ কেজি।
  • সুপার ফসফেটঃ ৩৮ কেজি।
  • মিউরিয়েট অব পটাসঃ ২০ কেজি।
এই সার দু'ভাগ করে বর্ষার আগে ও বর্ষার পরে গাছের গোড়া থেকে সামান্য দূরে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রতি বার সার দেওয়ার পর সারির মাঝের নালার মাটি তুলে গাছের সারিতে দু-এক ইঞ্চি পরিমাণ দিয়ে সার ও গাছের গোড়া ঢেকে দিতে হবে। পটাশিয়াম আনারসের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান। 

গুরুত্ব হিসাবে নাইট্রোজেনের পরই পটাশিয়ামের স্থান। পটাশিয়াম প্রয়োগ করলে আনারসের ফল বড়, ওজনে ভারী ও মিষ্ট হয়, ফলের রং ভাল হয় এবং দূরে চালান দিলেও ফল সহজে নষ্ট হয় না। এছাড়া পটাশিয়াম প্রয়োগ করলে আনারস গাছ খাড়া থাকে এবং খরা ও অতিরিক্ত ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে।

আনারস গাছের জলসেচ


আনারস বৃষ্টির জলেই চাষ হয়। তবে সময়মত জলসেচ দিলে ফলন বাড়ে। সেজন্যে মাটি ও অবস্থা অনুযায়ী বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়ে ২০-২৫ দিন অন্তর জলসেচ দেওয়া দরকার। ফুল আসার আগে ও পরে প্রয়োজনমত জলসেচ দিতে হবে।

আনারসের অন্তর্বর্তী পরিচর্যা (Interculture operation)


আনারস জমির মাটি মাঝে মাঝে হালকা ভাবে কুপিয়ে আগাছা নষ্ট করে দিতে হবে। এর জন্যে বর্ষাকালে মাসে দু'বার ও অন্য সময় মাসে একবার আগাছা দমন করতে হবে। কারণ জমিতে আগাছা জন্মালে ফলের সংখ্যা কমে যায়, ফল ছোট হয় ও ফলের স্বাদ খারাপ হয়। এজন্যে সময়মত হাত দিয়ে আগাছা তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। 

আনারসের আগাছা সাধারণতঃ হাত দিয়েই পরিষ্কার করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী বছরে ছয়-সাত বার আগাছা তোলার কাজ করতে হয়। সারির মাঝের মাটি কোদাল দিয়ে হালকাভাবে কুপিয়ে বা চেঁচে দেওয়া দরকার। আগাছা নাশক ঔষধ প্রয়োগেও আগাছা দমন করা যায়। আগাছা নাশক ঔষধ দু'ভাবে প্রয়োগ করা যায়। যেমনঃ

(ক) চারা বসাবার আগে আগাছা দমন (Chemical Weed Control before Planting)


জমি চষে নতুন করে আগাছা বের হবার সুযোগ দিতে হবে। আগাছা ৬-৮ ইঞ্চি (১৫-২০ সেমি) বড় হলে একর প্রতি ৩-৪ কেজি ডালাপন ২০০ লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। এর দশদিন পর একর প্রতি আধ লিটার গ্রামোক্সন ২০০ লিটার জলে মিশিয়ে আবার স্প্রে করতে 'হবে। ঔষধ প্রয়োগের এক মাস পরে জমি তৈরী করে আনারসের চারা লাগাতে হবে।

(খ) গাছ থাকা অবস্থায় আগাছা দমন (Chemical Weed Control after Planting)


আনারস বাগিচায় আগাছা ৬-৮ ইঞ্চি (১৫-২০ সেমি) বড় হলে একর প্রতি আধ লিটার গ্রামোক্সন ২০০ লিটার (১১ টিন) জলে গুলে আনারস গাছের দুটো জোড়া সারির মাঝে ফাঁকা জায়গায় সাবধানে ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। আনারস গাছে যাতে ঔষধ না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এজন্যে নজলের উপর ঢাকনা (Nozzle hood) দিয়ে সাবধানে স্প্রে করতে হবে। 

প্রথম বছরে তিন-চারবার ঔষধ প্রয়োগ করে ভালভাবে আগাছা দমন করা যায়। দু-এক বছর ঔষধ দিয়ে আগাছা দমন করলে পরে ঔষধের প্রয়োজন কমে যাবে। এই পদ্ধতিতে সরাসরি আনারসের সারিতে ঔষধ দিয়ে আগাছা দমন করা না গেলেও এই পদ্ধতির কিছু সুবিধা আছে। ১৩৫ লিটার জলে ৩০-৪৫ মিলিলিটার প্লানোফিক্স (Planofix) গুলে গাছে ফুল ফোটার সম্ভাব্য সময়ের কিছু আগে এক একর আনারস গাছের মধ্যস্থল ভিজিয়ে দিলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। 

রাসায়নিক ঔষধ প্রয়োগ করে আনারস গাছে অসময়ে ফুল ধরান সম্ভব। আনারস গাছের ১২-১৩ মাস বয়সের সময় ক্যালসিয়াম কার্বাইড গোলা জল প্রয়োগে এক-দু'মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসে। প্রতি লিটার জলে ২০ গ্রাম হিসাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড মিশিয়ে দ্রবণ তৈরী করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচিত গাছের মাঝ বরাবর ৫০ মিলিলিটার মিশ্রণ ঢেলে দিতে হবে। এই ঔষধ সকালে প্রয়োগ করা উচিত।

কোন মাসে আনারসের ফল সংগ্রহ করা হয়


কাণ্ডের চারা লাগানোর ১৮-২২ মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। আনারস গাছে ফেব্রুয়ারী-এপ্রিল মাসে ফুল আসে এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফল পাকে। বর্ষাকালেই আনারসের বেশীর ভাগ ফল হয় এবং শীত কালে অল্প কিছু ফল হয়। ফল সম্পূর্ণভাবে পাকলে গাছ থেকে তুলতে হবে। ফল পুষ্ট হলে কাঁচা ফলের গাঢ় সবুজ রঙ ক্রমশঃ ফিকে সবুজ ও অবশেষে হলদে রঙে পরিবর্তিত হয়, ফলের চোখগুলো পুষ্ট হয় এবং ফলে মিষ্ট গন্ধ ছাড়ে। 

২-৪ ইঞ্চি (৫-১০ সেমি) লম্বা বোঁটাসহ ফল ধারাল অস্ত্র দিয়ে কেটে নিতে হবে। দূরের বাজারে পাঠাতে হলে ফলের মুকুট তেউড়টি ভাঙা চলবে না। শুকনা খড় দিয়ে ফল আবৃত করে ঝুড়িতে প্যাক করে দূদ্রের বাজারে পাঠাতে হবে। ফল সাবধানে নাড়াচাড়া করা দরকার। কারণ আঘাত পাওয়া ফল তাড়াতাড়ি পচে যায়।

আনারস গাছ লাগানোর দ্বিতীয় বছর ফল ও চারা পাওয়া যায়। একর প্রতি সাড়ে দশ হাজার গাছ থেকে দ্বিতীয় বছরে আনুমানিক পাঁচ হাজার ফল ও চার হাজার চারা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ বছরে আট হাজার করে ফল ও সাত হাজার করে চারা পাওয়া যাবে। একর প্রতি কুইন জাতের ফলন ৫০-৬০ কুইন্টাল ও কিউ জাতের ফলন ১০০-১২০ কুইন্টাল পর্যন্ত হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন