পেঁপে চাষের উপযুক্ত সময় - পেঁপে চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতকরণ (Soil preparation)
পেঁপে চাষের উপযুক্ত সময় এবং পেঁপে চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতকরণ এ সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে এ আর্টিকেলটি পড়তে হবে।
এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করছি কোন মাটিতে পেঁপে চাষ করা সম্ভব এবং পেঁপে (Papaya) গাছের বৈশিষ্ট্য। এছাড়া আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়া অনুরোধ রইল।
বৈজ্ঞানিক নামঃ (Scientific name)
বৈজ্ঞানিক নামঃ Carica Papaya L.
গোত্রঃ (Family or Natural order): Caricaceae
ভূমিকা
পেঁপে একটি সুস্বাদু, সুমিষ্ট ও উপকারী ফল। চারা লাগাবার ৮-৯ মাসের মধ্যেই গাছে ফল ধরে। স্বাস্থ্যপ্রদ ও খাদ্য হজম করার শক্তির জন্যে পেঁপে বহুদিন থেকেই আমাদের দেশে পরিচিত। আমেরিকার উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চল পেঁপের আদি জন্মস্থান। কথিত আছে যে, ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগীজ কর্তৃক পেঁপে ভারতবর্ষে প্রবেশ লাভ করে।
পেঁপে (Papaya) গাছের বৈশিষ্ট্য
পেঁপে কোমল কাণ্ডবিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকার চিরহরিৎ ভঙ্গুর বৃক্ষ (Small evergreen fragile tree) 1 কাণ্ড ঈষৎ ফাঁপা এবং মাথায় মুকুটের মত দীর্ঘ ও ফাঁপা বৃন্তযুক্ত পত্রগুচ্ছ আছে। সাধারণত ছোট অবস্থায় কাণ্ড সোজা ও শাখাবিহীন হয়। কিন্তু কয়েক বছর পর গাছের আগার দিকটা ক্রমশঃ সরু হয়ে যায়। দৈহিক বৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং কাণ্ড থেকে খাড়া শাখা-প্রশাখা বের হয়।
শাখার ফলগুলো আকারে ছোট হয়। কাণ্ডের আগা ক্রমশঃ বাড়ে এবং সেখানে নতুন পাতার কোলে ফল ধরে। পাতার বয়স বেশী হলে সেগুলি হলদে বর্ণের হয়ে গাছ থেকে খসে পড়ে। তখন ফলগুলো সহজে দৃষ্টি গোচর হয়। পেঁপে গাছ ১৫-২০ বছর বাঁচলেও এর কার্যকরী জীবনকাল সাধারণত চার বছর। লাগানোর ছ'মাসের মধ্যেই গাছে ফল ধরে এবং দু-তিন বছর ধরে ভাল ফলন পাওয়া যায়। বেশী বয়সের গাছে ফল আকারে ছোট হয় ও ফলন কমে যায়। সেজন্যে বাগানে তিন বছরের বেশী পুরাতন গাছ রাখা উচিত নয়।
পেঁপে গাছের গোত্র পরিচিতি
পেঁপে একলিঙ্গ (Unisexual) উদ্ভিদ। তিনশ্রেণীর পেঁপে গাছ আছে। যথাঃ
ক) পুরুষ গাছ (Male Plant)
(খ) স্ত্রী গাছ (Female Plant) এবং
(গ) উভলিঙ্গ (Hermaphrodite Plant)
ক) পুরুষ গাছ (Male Plant)
এই গাছে কেবল মাত্র পুং পুষ্প (Male or Staminate flower) হয়। পুরুষ ফুলের ডাঁটি (Flower stalk) খুব লম্বা (১-১-৩ মিটার); সেগুলি কাণ্ডের বাইরে ঝুলতে থাকে। পুরুষ ফুলগুলো ছোট হয় এবং তাতে পরাগ রেণু উৎপন্ন হয়। পুরুষ গাছে সাধারণত ফল হয় না। পুরুষ গাছ বয়স বাড়লে উভলিঙ্গ ফুল ধারণ করে।
(খ) স্ত্রী গাছ (Female Plant)
এই গাছে শুধুমাত্র স্ত্রী পুষ্প (Female or Pistillate flower) হয়। কাণ্ডের কাছাকাছি পাতার কক্ষে স্ত্রীপুষ্প এককভাবে বা গুচ্ছাকারে উৎপন্ন হয়। স্ত্রীপুষ্প আকারে বড়, পীতাভ বর্ণের ও প্রায় ২-৫ সে.মি লম্বা এবং বেশ বড় আকারের ডিম্বাশয়টি পাঁচটি পীতবর্ণে মোচড়ানো (twisted) মোটা (fleshy) পাপড়ি দ্বারা আবৃত থাকে। নিষিক্ত ডিম্বাশয়টি ফলে পরিণত হয়। স্ত্রী ফুলে কোন পুং স্তবক থাকে না। স্ত্রীফুল থেকে উৎপন্ন ফল বর্তুলাকৃতি বা ডিম্বাকৃতি হয়, শাঁস হলদে বা কমলা বর্ণের হয় এবং পেঁপেতে কালো বর্ণের প্রচুর বীজ থাকে।
(গ) উভলিঙ্গ (Hermaphrodite Plant)
এই গাছে উভলিঙ্গ (bisexual) ফুল হয়। উভলিঙ্গ ফুল স্ত্রীফুলের মতই; তবে সামান্য মোটা ও লম্বা ধরনের হয়। স্ত্রী ফুলের মতই উভলিঙ্গ ফুল পাতার কক্ষে কাণ্ডের খুব কাছাকাছি জন্মায়। এই ফুলে স্ত্রী স্তবক ও পুং স্তবক উভয়ই বর্তমান। এজন্যে এই ফুলে স্বপরাগ যোগ (Self pollination) ঘটে বলে ফল ধারণের বিশেষ কোন অসুবিধা হয় না।
উভলিঙ্গ ফুল থেকে উৎপন্ন ফল প্রায় নলাকৃতি হয়। ফলের শাঁস বেশ পুরু, দৃঢ় ও কমলাবর্ণের হয় এবং কেন্দ্রীয় গহ্বরটি (Central cavity) খুব সরু ও বীজে পূর্ণ থাকে। উভলিঙ্গ ফুল থেকে উৎপন্ন ফলের আকার সাধারণত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। গাছটি পুরুষ, স্ত্রী বা উভলিঙ্গ হবে, তা গাছে ফুল আসার আগে পর্যন্ত বোঝা যায় না। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছ কি পরিমাণ পুরুষ, স্ত্রী বা উভলিঙ্গ হবে তা অনেকটা জাতের ওপর নির্ভর করে।
বীজশূন্য (Seedless Papaya)
অনেক সময় দেখা যায় পেঁপেতে আদৌ বীজ থাকে না। এ রকম পেঁপেকে বীজশূন্য পেঁপে বলা হয়। বিশুদ্ধ স্ত্রী ফুল যদি ঘটনাচক্রে পুরুষ ফুলের পরাগরেণু দ্বারা নিষিক্ত না হয় তবে সেক্ষেত্রে স্বীজশূন্য পেঁপে উৎপন্ন হয়। বীজশূন্য পেঁপে ইতর পরাগযোগে উৎপন্ন পেঁপের থেকে আকারে ছোট হয়।
তামিলনাড়ু কৃষি-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ২০০ পি-পি-এম (200 parts per million i.e. 200 mg. G.A. dissolved in a litre of water), জি-এ- (Gibberelic acid) স্ত্রীফুলে প্রয়োগ করলে মধুবিন্দু জাতের ক্ষেত্রে বীজশূন্য পেঁপে উৎপন্ন হতে পারে। অপর পক্ষে অন্য পেঁপেতে (Untreated fruits) ৫০০-৮০০ বীজ থাকে। জি-এ প্রয়োগ করা পেঁপেতে খাদ্যপ্রাণ-সি এর পরিমাণও দ্বিগুণ হয়।
পেঁপে চাষের উপযুক্ত সময়
জলবায়ু (Climate): পেঁপে ক্রান্তীয় শস্য। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া পেঁপে চাষের বিশেষ উপযোগী। ৩৮০-৪৪° সেলসিয়স উষ্ণতা ও বাৎসরিক ১৫০-২০০ সে-মি- বৃষ্টিপাত পেঁপে চাষের পক্ষে অনুকূল, বৃষ্টিপাত কম হলে উপযুক্ত পরিমাণ সেচের প্রয়োজন হয়। পেঁপে গাছ তুষারপাত ও অতিরিক্ত ঠাণ্ডা (৫° সেলসিয়সের নীচে) আবহাওয়া সাধারণত সহ্য করতে পারে না।
ভারতবর্ষে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১০৫০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পার্বত্য অঞ্চলেও পেঁপের চাষ করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মহিশূর, তামিলনাড়, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যের সমতল অঞ্চলে পেঁপের চাষ হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত অঞ্চলই পেঁপে চাষের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল।
গরম আবহাওয়ার অভাবে পেঁপের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ও পরিপক্কতা (Maturity & ripening of fruit) বিঘ্নিত হয়। শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায় পেঁপের মিষ্টতা হ্রাস পায়। অধিক আর্দ্রতায় ফলের গুণাবলী (যথা স্বাদ ও মিষ্টতা) বিশেষ বিঘ্নিত হয়। পেঁপে গাছ গোড়ায় জল দাঁড়ানো সহ্য করতে পারে না। ঝড়ো আবহাওয়া পেঁপে চাষের পক্ষে প্রতিকূল।
কারণ পেঁপে গাছের গুঁড়ি খুব নরম ও শেকড় মাটির খুব নীচে না থাকায় সহজেই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতির হাত থেকে পেঁপে গাছকে বাঁচানোর জন্য সাধারণত যে দিক থেকে ঝড় আসে, সেই দিকে লাইনে ঘন করে সুবাবুল, শিশু, আকাশমণি, ঝাউ, দেবদারু, বাবলা ইত্যাদি গাছ লাগাতে হবে। এ সব গাছ ঝঞ্ঝারোধী (Wind break) গাছ হিসাবে কাজ করে।
কোন মাটিতে পেঁপে চাষ করা সম্ভব
জলনিকাশের ভাল ব্যবস্থা থাকলে যে কোন মাটিতে পেঁপে চাষ করা সম্ভব। তবে দোআঁশ, বালি-দোআঁশ, এঁটেল-দোআঁশ ও পলি-দোআঁশ মাটি পেঁপে চাষের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। নদী উপত্যকায় গভীর ও উর্বর মাটিতে পেঁপে ভাল জন্মে। পেঁপে চাষের জন্য মাটির উপরিভাগে পর্যাপ্ত রস ও খাদ্য থাকা দরকার। পেঁপে গাছ গোড়ায় জল বসা সহ্য করতে পারে না। পেঁপে গাছের গোড়ায় জল বসলে “কলার রট” (Collar rot) নামক এক প্রকার ছত্রাক ঘটিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গাছ অকালে মরে যায়। এঁটেল মাটির জলধারণ ক্ষমতা বেশী হওয়ায় পেঁপে চাষের পক্ষে উপযোগী নয়।
পেঁপে চাষের জন্য মাটি প্রস্তুতকরণ (Soil preparation)
চারা লাগাবার আগে বার বার লাঙ্গল ও মই দিয়ে ভালভাবে মাটি তৈরী করতে হবে। বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই জমি তৈরী করা একান্ত দরকার। জমি তৈরীর সময় একর প্রতি ১০-১২ গাড়ী গোবর বা আবর্জনা সার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জমি ভালভাবে সমতল করে জলসেচ ও জলনিকাশের নালা তৈরী করে।
নির্দিষ্ট দূরত্বে ৪৫ সেমি লম্বা, ৪৫ সেমি চওড়া ও ৪৫ সেমি গভীর গর্ত খুঁড়তে হবে। কয়েকদিন রোদ খাওয়াবার পর প্রতি গর্তের মাটির সাথে ২০ কেজি গোবর সার বা আবর্জনা সার ও ৯০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫ গ্রাম সুপার ফসফেট ও ৭৫ গ্রাম মিউরিয়েট অব পটাশ মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে।