কোয়েল পাখির ডিম জীবাণুমুক্তকরণ - কোয়েল পাখির ডিম ফুটানোর পদ্ধতি

কোয়েল পাখি ডিম জীবাণুমুক্তকরণ এবং কোয়েল পাখির ডিম ফুটানোর পদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অবশ্যই মনোযোগ সহকারে আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
কোয়েল পাখির ডিম ফুটানোর পদ্ধতি

এই আর্টিকেলে আমরা আরো আলোচনা করেছি কোয়েল পাখির ফোটানোর ডিম বাছাই এবং কোয়েল পাখি কত বছর বাঁচে। এছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টপিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো জানতে হলে আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইলো।

কোয়েল পাখি কত দিনে ডিম পারে


মাদী কোয়েলগুলো ৬-৭ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করে। আট সপ্তাহে ডিম উৎপাদন ৫০%-এ পৌঁছে। দশ সপ্তাহে তা বেড়ে গিয়ে ৮০% হয় এবং ১৫ সপ্তাহের মধ্যে ডিম উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে (৯০%) পৌঁছায়। তবে ২৬ সপ্তাহের পর থেকে ডিম পাড়ার হার কমতে থাকে। কোয়েল পাখি প্রথম বছর প্রায় ২৯০-৩০০টি ডিম পাড়ে। প্রথম বছরে উৎপাদিত ডিমের ৪৮% অর্থাৎ প্রায় ১৪০-১৪৫টি ডিম দ্বিতীয় বছর পেড়ে থাকে। 
কোয়েল পাখির ফোটানোর ডিম কি ভাবে সংরক্ষণ করতে হয়

সাধারণত ১৩৮ সপ্তাহ বয়সে ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যায়। কোয়েল পাখিদের ডিম পাড়ার হার আলোর ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাই পর্যাপ্ত উৎপাদন পেতে হলে প্রতিদিন এদের ঘরে ১৬ ঘণ্টা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়েল পাখি শতকরা ৭৫ ভাগ ডিম বিকাল ৩-৬টার মধ্যে, শতকরা ২০ ভাগ ডিম সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে এবং বাকি ডিম এ সময়ের পরে পেড়ে থাকে।

কোয়েল পাখি কত বছর বাঁচে


জীবনকালঃ আমাদের দেশে কোয়েল সাধারণত ৩-৪ বছর বেঁচে থাকে। মর্দাগুলোর বেঁচে থাকার হার মাদীগুলোর থেকে বেশি। তবে বাণিজ্যিক খামারগুলোতে সাধারণত লেয়ার কোয়েলগুলোকে ৬০ (৬+৫৪) সপ্তাহ বয়সের বেশি পালন করা হয় না।

কোয়েল পাখির ফোটানোর ডিম উৎপাদন


ফোটানোর জন্য কোয়েল পাখির ডিম উৎপাদন করতে হলে অবশ্যই কোনো প্রতিষ্ঠিত এবং ভালো প্রজনন খামার (Breeder farm) থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করে পালন করা উচিত। আর যারা শুধু ফোটানোর ডিম সংগ্রহ করতে চান, তাদেরকেও কোনো নামকরা ও প্রতিষ্ঠিত খামার থেকেই তা সংগ্রহ করতে হবে। প্রজনন খামারে ডিমের অধিক উর্বরতা এবং স্ফুটন ক্ষমতা পেতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যথা-
  • ক. কোয়েল পাখির ডিম উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত প্যারেন্ট স্টকের (Parent stock) বয়স ১০-৩০ সপ্তাহের মধ্যে হতে হবে।
  • খ. প্যারেন্ট স্টকে মর্দা ও মাদী অনুপাত হবে ১: ২। এতে ডিমের উর্বরতা এবং স্ফুটন ক্ষমতা যথাক্রমে ৯৩% ও ৮০% পাওয়া যাবে।
  • গ. ব্রিডার খাঁচা বা পেনে (Breeder cage or pen) মর্দা কোয়েল প্রবেশ করানোর চারদিন পর থেকে ডিম সংগ্রহ শুরু হবে এবং মর্দা সরিয়ে নেওয়ার পর তৃতীয় দিন পর্যন্ত তা চলবে।
  • ঘ. প্যারেন্ট স্টককে সব সময় সুষম খাদ্য প্রদান করতে হবে।
  • ঙ. ঠোকরা-ঠুকরি (Canniblism) দূর করতে সঠিকভাবে কোয়েলের ঠোঁট কাটতে (Debeaking) হবে।

কোয়েল পাখির ফোটানোর ডিম সংগ্রহ


ফোটানোর কোয়েল পাখির ডিম যত্ন সহকারে সংগ্রহ করা উচিত। ডিম ঘন ঘন সংগ্রহ করতে হবে। মৌসুম, আবহাওয়া, হাউজিংয়ের ধরন প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে ডিম সংগ্রহের সময়ের হেরফের ঘটতে পারে। তবে রাত ৯টার পর কখনোই ফোটানোর জন্য ডিম সংগ্রহ করা যাবে না। এগুলোকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত এবং পরিষ্কার ডিম রাখার ট্রে'তে সংগ্রহ করতে হবে। যেহেতু কোয়েলের ডিমের খোসা অত্যন্ত পাতলা হয় তাই এগুলো সংগ্রহ করার সময় বেশ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে ডিম ফেটে বা ভেঙে না যায়।

কোয়েল পাখির ফোটানোর ডিম বাছাই


কোয়েল পাখির ডিমের গুণগত মানের ওপর ডিম ফোটার হার এবং সুস্থ-সবল বাচ্চা উৎপাদন নির্ভর করে। সুতরাং ভালো গুণসম্পন্ন ডিম বাছাই করতে হবে এবং কোয়েল পাখি ডিম জীবাণুমুক্তকরণ করতে হবে। ডিমের খোসা, রঙ, আকার, আকৃতি, ওজন ইত্যাদি দেখে ডিম বাছাই করতে হয়। ডিম বাছাইয়ের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। যথা-
  • ক. আকার ও ওজন: অতিরিক্ত বড়ো কিংবা ছোটো ডিম বাছাই করা যাবে না। মাঝারি আকারের একই মাপের ডিম থেকে বেশি বাচ্চা পাওয়া যেতে পারে। এ জন্য ৯-১১ গ্রাম ওজনের ডিম বাছাই করা উচিত।
  • খ. খোসা : ভাঙা, ফাটা, বাঁকা প্রভৃতি খোসাবিশিষ্ট ডিম বাদ দিয়ে মসৃণ এবং শক্ত খোসাবিশিষ্ট ডিম বাছাই করতে হবে।
  • গ. রঙ: যে লাইনের কোয়েলের জন্য যে রঙ স্বাভাবিক সে রঙের ডিমই ব্যবহার করা উচিত। অস্বাভাবিক রঙের ডিম বাছাই করা উচিত নয়।
  • ঘ. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা: অপরিচ্ছন্ন কিংবা ময়লাযুক্ত ডিম ব্যবহার করা উচিত নয়।

কোয়েল পাখির ডিম জীবাণুমুক্তকরণ


কোয়েল পাখি ডিম পাড়ার পর থেকেই এতে নানা ধরনের জীবাণুর দূষণ শুরু হয়। তাই ফোটানোর ডিম সংগ্রহ এবং বাছাই করার পর, সংরক্ষণের পূর্বেই এগুলোকে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। ডিমগুলোতে ১০ মিনিট ধরে ফরমালডিহাইড (Formaldehyde) গ্যাসের ধোঁয়া দিতে হবে অর্থাৎ ফিউমিগেশন্ (Fumigation) করতে হয়। 

৪০ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ৮০ মিলিলিটার ফরমালিনের (Formaline) সাথে মিশিয়ে ফিউমিগেশন্ প্রকেষ্ঠের ১ ঘন মিটার জায়গা (Air space) ফিউমিগেট্ করা যায়। তবে কোয়েল পাখির ডিমগুলো ফিউমিগেশন্ প্রকোষ্ঠে ২০ মিনিট রাখলে ১ ঘন মিটার জায়গার জন্য ২০ গ্রাম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ৪০ মিলি ফর্মালিনের সাথে মেশালেই চলে। 

ফিউমিগেশন্ শেষ করার ক্ষণিক পরই যদি উক্ত প্রকোষ্ঠ অন্য কাজে ব্যবহার করতে হয় তবে সমপরিমাণ ২৬-২৯% অ্যামোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড দিয়ে তা নিরপেক্ষ করে নিতে হবে। ফিউমিগেশন্ প্রকোষ্ঠের তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা যথাক্রমে ২১.১০ সেলসিয়াস (৭০০ ফারেনহাইট) এবং ৭৫% হবে।

কোয়েল পাখির ফোটানোর ডিম কি ভাবে সংরক্ষণ করতে হয়


কোয়েল পাখি ডিম জীবাণুমুক্তকরণ করে ফিউমিগেশনের পর ডিম ১৩° সে. (৫৫.৪° ফা.) তাপমাত্রা এবং ৭৫-৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতাসম্পন্ন ডিম শীতলিকরণ যন্ত্র (Egg cooler) রয়েছে এমন ঘরে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এভাবে কোয়েল পাখির ডিম ৬-৭ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এতে ডিমের স্ফুটন ক্ষমতার ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে না।

কোয়েল পাখির ফোটানোর ডিম কি ভাবে বসানো হয়


কোয়েল পাখির ডিম ফোটানোর জন্য সংরক্ষণ কক্ষ থেকে ডিম বের করে আনতে হবে। তবে সংরক্ষণ কক্ষ থেকে বের করার পরপরই ইনকুবেটরের সেটার (Setter) প্রকোষ্ঠে বসানো উচিত নয়। ডিম বের করে কোয়েল পাখি ডিম জীবাণুমুক্তকরণ করে প্রথমে সেগুলো ২১.১-২৩.৯০ সে. (৭০-৭৫ ফা.) তাপমাত্রাবিশিষ্ট কক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর তা সেটার বসাতে হবে। এতে সঠিকভাবে ডিম ঘেমে আবার শুকানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে।

কোয়েল পাখির ডিম ফুটানোর পদ্ধতি


ডিম ফোটানোঃ কোয়েলের ডিম মুরগি কিংবা অন্যান্য পোল্ট্রির মতোই দুই পদ্ধতিতে ফোটানো যায়। যথা- ১. প্রাকৃতিক পদ্ধতি এবং ২. কৃত্রিম পদ্ধতি। তবে যে পদ্ধতিতেই ফোটানো হোক না কেনো ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ১৬-১৮ দিনই (গড়ে ১৭ দিন) সময় লাগবে।

প্রাকৃতিক পদ্ধতিঃ বাণিজ্যিক কোয়েল কখনো কুঁচে হয় না। বিজ্ঞানীদের উন্নত বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে ডিমে তা দেওয়ার স্বভাবটি এরা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে যা এদের বুনো বংশধরদের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে। সে কারণে প্রাকৃতিকভাবে এদের ডিম ফোটাতে হলে মুরগিই উত্তম। এ পদ্ধতিতে ছোটো আকারের কুঁচে (Broody) মুরগির নিচে রেখে একসাথে ২০-২৫টি ডিম ফোটানো যেতে পারে।

তবে এ পদ্ধতিটি ক্ষুদ্র খামারি বা সখের কোয়েল পালকদের জন্যই উপযুক্ত। কিন্তু ছোটো, মাঝারি বা বড়ো খামারিদের জন্য এটি মোটেও লাভজনক নয়। এ পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর পর বাচ্চাগুলোকে সাথে সাথে ব্রুডার ঘরে ব্রুডারের (Brooder) বা বাচ্চা তাপানোর যন্ত্রের নিচে স্থানান্তর করতে হবে। তা না হলে মুরগির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে বাচ্চা মারা যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

কৃত্রিম পদ্ধতিঃ কোয়েল পাখি ডিম জীবাণুমুক্তকরণ করে হ্যাচারিতে কৃত্রিম পদ্ধতিতে ইকুবেটরে (Incubator) বা কোয়েল পাখির ডিম ফোটানোর যন্ত্রে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়। দেশি বা বিদেশি ছোটো বা বড়ো যে কোনো ধরনের ইকুবেটরেই সফলতার সাথে ডিম ফোটানো যায়। বিদেশি ইকুবেটরগুলো উৎকৃষ্ট মানের হলেও দাম খুব বেশি পড়ে। 

তাই স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত দেশি ইকুবেটিরগুলো এ কাজে ব্যবহার করা যায়। একই ইকুবেটরে মুরগির ডিমের সাথেও কোয়েলের ডিম ফোটানো যায়। ইনকুবেটরে সঠিক তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং বায়ু চলাচল (Ventilation) নিয়ন্ত্রণ করা এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত ডিম উল্টে-পাল্টে দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url