বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিদের শীতকালের পরিচর্যা

পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি বস্তু মধু। মধু আহরিত হয় মৌচাক থেকে। মৌমাছিরা সরাসরি মানুষের উপকার করে থাকে। ধর্মগ্রন্থ কোরআন, বেদ, রামায়ণসহ বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিপত্রে মৌমাছির কথা উল্লেখ আছে অনেক স্থানে। 
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিদের শীতকালের পরিচর্যা
অতি প্রাচীনকালে মৌচাক থেকে সংগ্রহ করা মধু মোম রাজকর এবং উপহার হিসেবে গ্রহণ করা হতো। সে সময় বন্ধুত্ব করার শুরুতে বন্ধুকে এক বোতল মধু উপহার দেওয়ার রীতি ছিলো। তাছাড়া ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মধুর ব্যবহার হতো। খাদ্য ও ওষুধ হিসেবে মধুর ব্যবহার এখনো বর্তমান মৌচাক থেকে সংগ্রহ করা মোমেরও তখন ছিলো বিশেষ কদর।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিদের পরিচর্যা


মৌমাছিদের ধারাবাহিক পরিশ্রম, একতা, আত্মত্যাগ এবং সবাই সমান কাজ করার যে গুণ তা মানুষের জীবনে অনুকরণ করার মতো। এক ফোঁটা মধু সংগ্রহের জন্য একটা শ্রমিক মৌমাছিকে কমপক্ষে ৪০০ থেকে ৫০০ ফুলে চরে বেড়াতে হয়। আমি এখানে প্রতিপালন সম্পর্কে আলোচনা করবো। অর্থনৈতিক দিক থেকে মৌমাছি পালন বিশেষ লাভজনক। 

ফুলে ফুলে পরাগায়নের মাধ্যমে ফলের যে উৎপাদন তাতেও মৌমাছিদের বিশেষ অবদান রয়েছে। এক সময় দুনিয়া জুড়ে মৌমাছি পালনের যে পদ্ধতি ছিলো, তা ছিলো খুবই নিষ্ঠুর পদ্ধতি। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে উন্নত বিশ্বে মৌমাছি পালনের নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আমাদের দেশে ১৮৮৩ সালে প্রথম বিজ্ঞান সম্মতভাবে কাঠের ফ্রেমে মৌমাছি পালনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। 
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিদের পরিচর্যা
কিন্তু নানা রকম সমস্যার কারণে ওই ব্যবস্থা তখন তেমন এগোয় নি। এটা খুব দুঃখজনক বিষয়। তারপর উপমহাদেশের ১৯১১ সালে রেভা, নিউটন বহু যুবকদের মৌমাছির পালনের প্রশিক্ষণ দেন। তিনি মৌমাছি পালনের জন্য কাঠের 'মৌ বাক্স' তৈরি করেন। কিন্তু গ্রাম-বাংলার মানুষ এই পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন করতে যুগ যুগ ধরেও জানো অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারছিল না তবে আসার কথা প্রতি সম্পৃক্ত মৌমাছি পালন করা বাঙালির আদর্শ শখে পরিণত হয়েছে।

মৌমাছিদের গ্রীষ্মকালের পরিচর্যা


মধু সংগ্রহের কাল বসন্ত শেষ হওয়ার পর আসে গ্রীষ্ম। এ সময় যদি কলোনি থেকে সমস্ত মধু নিষ্কাশন করে নিঃশেষ করে দেওয়া হয় তখন মৌমাছিদের কলোনিতে বাচ্চা সংকট দেখা দেয়। অন্যদিকে বসন্তকালে মধু সংগ্রহের জন্য একটানা খাটুনির কারণে বয়স্ক মৌমাছিরা অকালে মারা যায়। তাই এ সময় মো-বাক্স শূন্য হয়ে যেতে বসে। 

গ্রীষ্মকালে মৌমাছিদের শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। শত্রু লুণ্ঠনকারী মৌমাছিদের থেকে কলোনিকে রক্ষা করাই তখন মৌমাছিদের মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। এই সময়টায় প্রচণ্ড গরম থাকে। কলোনিকে তাপের হাত থেকে রক্ষা করতে যথাযথ চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হয়। গ্রীষ্মকালে মৌমাছিদের কলোনির প্রতি বিশেষ নজর না দিলে শ্রমিক মৌমাছিরা বাইরে যায় না। 

বাচ্চাদের বড়ো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। রানিও আর ডিম পাড়ে না। ডিম পাড়লেও সেই ডিমের তেমন কোনো পরিচর্যা হয় না। বাচ্চারা বড়ো হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে মধুকক্ষে পর্যাপ্ত মধু নেই তখন তারা দলে দলে পালিয়ে যায়। এভাবে পালিয়ে গেলে কলোনি তখন বিশেষ দুরবস্থার মধ্যে পড়ে। মৌমাছিরা পুরনো কলোনি ত্যাগ করার মুহূর্তে প্রথমে শূন্যে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। 

এই অবস্থায় মৌমাছি পালনকারীদের সবচেয়ে বড়ো কাজ হচ্ছে Broodlessness রোধ করা। এ ছাড়া শ্রমি মৌমাছির সংখ্যা বাড়ানো এবং মৌমাছিদের পলায়ন রোধ করা। যেসব কলোনিতে প্রজনন কাজ চলতে থাকে অর্থাৎ রানি মৌমাছি ডিম পাড়ে ডিম থেকে শূককীট পর্যায় অতিক্রম করে মৌমাছি বেরিয়ে আসে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে সেখানে কিন্তু মথপোকা কালো পিঁপড়ে প্রভৃতি শত্রুরা কলোনির তেমন ক্ষতি করতে পারে না। 

দস্যু মৌমাছিরাও মধু লুন্ঠন করতে আসে না। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তাই মৌমাছির কোনো কলোনি দুর্বল হলেই শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে কেউ তাদের অত্যাচার করতে সাহস করে না। তাই দুর্বল কলোনিতে প্রথম কাজ হচ্ছে নতুন রানি সৃষ্টি করে কলোনিকে সবল করে তুলতে হবে। মধুকক্ষে সবসময় কিছু মধু সঞ্চয় করে রাখতে হবে। তিনি গোলা পানি খাদ্যপাত্রের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। এভাবে মৌমাছির জন্য দুর্যোগকাল গ্রীষ্মকালে মৌমাছিদেরকে কলোনিতে ধরে রাখার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিদের বর্ষাকালীন পরিচর্যা


গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিন শেষ হওয়ার পরই আর বর্ষাকাল। কোনো কোনো এলাকায় বর্ষাকালে তারা একদম বাইরে বের হতে পারে না। যদি মধু সংগ্রহের জন্য বাইরে যায় তবে অনেক সময় হঠাৎ করে ঝড় তুফান আসার কারণে তারা মারা যায়, কলোনিতে আর ফিরতে পারে না। এ কারণে বর্ষাকালে কলোনিতে মৌমাছির সংখ্যা কমে যায়। 
বর্ষাকালটাই একটু স্যাঁতস্যাঁতে ধরনের থাকায় মৌমাছিদের জন্য পরিবেশটা প্রতিকূল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মৌমাছিরা অলস হয়ে পড়ে। অস্থির হয়ে যায। আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়। এ সময় মধুকোষের মধু তরল হয়ে যায়। পরাগ কোষের পরাগগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালের মতো বর্ষাকালেও কলোনিতে মৌমাছিদের শত্রু বৃদ্ধি পায়। 

এ সময় মৌ-বাক্সের মধু না থাকলে চিনি গোলা পানি আর পরাগের অভাব হলে সয়াবিনের ময়দা খাওয়াতে হবে। ফাঁকা কোষওয়ালা একটা ফ্রেম বাক্স থেকে তুলে শূন্য কোষ সয়াবিনের ময়দা দ্বারা পূরণ করে দিয়ে পুনরায় ফ্রেমটি যথাস্থানে বসিয়ে দিতে হবে। এই মাসে কোনো কোনো সময় দেখা যায় রানি মারা পড়ে এবং রানি শূন্য কলোনিতে শ্রমিক মৌমাছিরাই ডিম পাড়তে শুরু করে। 

তবে সেই ডিমগুলো হয় অনুর্বর। যে কলোনিতে শ্রমিক মৌমাছিরা ডিম পাড়তে শুরু করে সেই কলোনিতে নতুন রানি স্থাপন করেও লাভ হয় না। কারণ তখন শ্রমিক মৌমাছিরা নতুন রানিকে মেনে নিতে চায় না। এ অবস্থায় কলোনি বিলুপ্ত করে দেওয়াই উত্তম।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শরৎকালের মৌমাছিদের পরিচর্যা


পার্বত্য অঞ্চলে বসন্তের পর শরৎই হচ্ছে দ্বিতীয় মধু সংগ্রহের কাল। তাই এ সময় মৌমাছি পালনকারীগণকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে কোনো কারণে যেনো মৌমাছিরা ঝাঁক ত্যাগ না করে। এই মধু ঋতুতে মৌমাছিদের খুবই সতর্কতার সাথে নাড়াচাড়া করতে হবে। এ সময়ে কোনো কোনো কলোনিতে নতুন রানির জন্ম হয়। 

যার ফলে পুরনো রানির আধিপত্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো এবং নতুন রানি পরস্পর কোনো বিবাদ না করে দুজনে বিভিন্ন কোষে ডিম পাড়ে। এ অবস্থা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় না। পুরনো রানি কিছুদিন পর এক ঝাঁক মৌমাছিসহ কলোনি ত্যাগ করে চলে যায়। পর্যাপ্ত মধু সংগ্রহের সময় দুই রানির উদ্ভব হলে মৌমাছিদের দলের মধ্যে রানিসহ ঝাঁক ত্যাগ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। 
তারা কলোনি ত্যাগ করে, অথচ তখন প্রচুর মধু সংগ্রহের জন্য অধিক সংখ্যক মৌমাছির প্রয়োজন। তাই কলোনিতে দুই রানির আবির্ভাব ঘটলেই কলোনিকে ভাগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি নতুন রানিসহ মৌমাছির একটা ঝাঁক বেরিয়ে যায় তবে নতুন রানিকে তার দলবলসহ পুরনো বাক্সের স্ট্যান্ডের ওপর একটা নতুন বাক্সে স্থাপন করতে হবে। 

আর পুরনো কলোনিকে দূরে সরিয়ে নিয়ে অন্য একটা স্ট্যান্ডের উপর স্থাপন করতে হবে। সমতল অঞ্চলে শরৎকাল মোটেই মধু সংগ্রহের কাল নয়। যদি গ্রীষ্মকাল কিংবা বর্ষাকালের পরিবেশ দীর্ঘদিন থাকে তবে শরৎকালেও সমতল অঞ্চলে বর্ষাকালের মতো পরিচালন ব্যবস্থা অনুসরণ করতে হবে।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছিদের শীতকালের পরিচর্যা


মৌমাছিরা নিজেরাই তাদের কলোনির মধ্যে শীতাতপ অবস্থা বজায় রাখে। ৯০ থেকে ৯৫ ফারেনহাইট তাপমাত্রা তাদের জন্য সহনীয়। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ওরা মধু খায় আর ডানা নাড়ায় তাতে বাতাস হয়। আর শীতকালে চাকের ওপর (Insulating) এক ধরনের প্রলেপের ব্যবস্থা করে। যেসব এলাকায় প্রবল শীত পড়ে, বরফ পড়ে সেই সকল এলাকার সাধারণ মৌ-বাক্সের ভেতরের মৌমাছিদের কলোনি প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে রক্ষা পায় না। 

যেসব এলাকায় দিন এবং রাতের তাপমাত্রার হেরফের ঘটে বা শীত দীর্ঘস্থায়ী সেসব অঞ্চলের মৌমাছি পালকগণকেও অতিরিক্ত ইন্সুলেশন এর ব্যবস্থা করতে হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা বিভিন্ন রকমের হওয়ায় ইন্সুলেশনের ব্যবস্থাকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন