প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা দেশপ্রেম - স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম
প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা শুদ্ধাচার এখানে ক্লিক করুনপ্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা স্বদেশপ্রেম, দেশপ্রেম, স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম
এই প্রবন্ধের অনুসরণে লেখা যায়ঃ
দেশপ্রেম, স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম
জাতীয় জীবনে দেশপ্রেমের গুরুত্ব
মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
প্রবন্ধ-সংকেতঃ ভূমিকা, স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ, স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ও দৃষ্টান্ত, স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ, স্বদেশপ্রেমের উপায়, স্বদেশপ্রেমের উগ্রতা, স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতি, স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম, স্বদেশপ্রেম ও আমাদের কর্তব্য, উপসংহার।
"আমার এ দেশেতেই জন্ম যেন এ দেশেতেই মরি।"
ভূমিকাঃ
যে দেশ আলো দিলো, মুখে দিলো অন্নজল, দিলো পরনের বস্ত্র, তার প্রতি যদি সেই দেশের শ্যামল স্নেহে প্রতিপালিত সন্তানদের ভালোবাসা না থাকে, তবে তারা কেবল অকৃতজ্ঞই নয়-অধম। স্বদেশের মানুষ, স্বদেশের রূপ-প্রকৃতি, তার পশুপাখি, প্রতিটি ধূলিকণা তার সন্তানদের কাছে প্রিয়, পরম পবিত্র। স্বদেশের কাছে মানুষ সকল দিক দিয়েই ঋণী। স্বদেশপ্রেম সেই ঋণ-স্বীকার ও ঋণ শোধের উপায়মাত্র। জননী মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়েও গরীয়সী মহিমায় দীপ্ত। কবির ভাষায়-
"মিছা মণি মুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম তার চেয়ে রত্ন নাই আর।"
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপঃ
স্বদেশের প্রেম হচ্ছে নিজের দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, ভাষার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা। জন্মভূমির মাটি আলো-বাতাস, অন্ন-জলের প্রতি মানুষের মমত্ব অপরিসীম। জন্মভূমির ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের প্রতি থাকে তার একধরনের আবেগময় অনুরাগ।
জন্মভূমির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে উঠে তার শিকড়ের বন্ধন। স্বদেশের প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি এই অনুরাগও বন্ধনের নাম স্বদেশপ্রেম। মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার আবেগময় প্রকাশ ঘটে স্বদেশপ্রেমের মধ্যে। কবি বলেছেন
'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবাসে।'
স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ও দৃষ্টান্তঃ
স্বদেশের প্রতি প্রেম সর্বদাই উদার ও খাঁটি হয়। শিল্প-সাহিত্য চর্চায় কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে, বিশ্ব- সভ্যতায় অবদান রেখে বিশ্বসভায় দেশের গৌরব বাড়ানো যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এফ আর খান, ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস প্রমুখের অবদানে বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
স্বদেশপ্রেম মানুষের অন্তরে সদা বহমান থাকে। বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে তা আবেগ-উদ্বেগ হয়ে উঠে। স্বদেশপ্রেম দেশও জাতির অগ্রগতির লক্ষ্যে জ্বলন্ত প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। এডউইন আর্নল্ড বলেছেন-
"জীবনকে ভালোবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়।"
স্বদেশপ্রেমের উন্মেষঃ
মানুষসহ সকল প্রাণী তার গৃহ তথা আবাসস্থলকে ভালোবাসে। ভালোবাসে তার জন্মভূমিকে। তবে মানুষের মনে দেশপ্রেমের উন্মেষ হয় বিদেশে অবস্থানকালে, আর দেশের সংকটকালে। সংকট অতিক্রম করতে সংগ্রামী হয়ে উঠে মানুষ। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে। কবির ভাষায়-
"জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে ভরে যে, মৃঢ় সে শত ধিক তারে।"
কিংবা, বিদেশে তাই কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেন- অবস্থানকালে দেশের প্রতি প্রবল টান অনুভব করা যায়।
'স্বদেশের প্রেম যত, সেই মাত্র অবগত বিদেশেতে অধিবাস যার।'
প্রত্যেক দেশপ্রেমিক দেশের ও বিশ্বের মানুষের কাছে মৃত্যুর পরও মৃত্যুঞ্জয়ীরূপে সমাদৃত হয়ে থাকেন। মহাত্মা গান্ধী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
স্বদেশপ্রেমের উপায়ঃ
"স্বদেশের উপকারে নেই যার মন, কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন।"
দেশপ্রেম সবচেয়ে বড় ধর্ম। কারণ পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই, যে ধর্মে দেশকে ভালোবাসার নির্দেশ দেয়া হয় নি। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মানবজীবনে যেকোনো সময়ে যেকোনো স্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে পারে। স্বীয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মধ্যে দেশপ্রেম নিহিত।
জাতির জন্যে, দেশের জন্যে, প্রত্যেক মানুষের জন্যে, তা সে ছোট হোক বা বড় হোক তার কিছু না কিছু করার আছে। কৃষক কৃষি-উৎপাদন বাড়িয়ে, সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য সাধনার মাধ্যমেও দেশের প্রতি ভালোবাসা জ্ঞাপন করতে পারেন। স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। দেশের কল্যাণে ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে, বিশ্বসভ্যতায় অবদান রেখে দেশের গৌরব বাড়ানো যায়।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশ চন্দ্রবসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এফ, আর, খান প্রমুখের অবদানে বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। বস্তুত নিজের দৈন্যদশাকে তুচ্ছ করতে হবে এবং জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। তাইতো মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জন্মভূমির প্রতি মানুষের তীব্র আবেগ কাব্যে প্রকাশ করেছেন এভাবে-
'আমারও দেশের মাটির গন্ধে/ভরে আছে সারা মন, শ্যামল কোমল পরশ ছড়াতে/নেই কিছু প্রয়োজন।'
স্বদেশপ্রেমের বিকৃত রূপ/উগ্রতাঃ
দেশের প্রতি ভালোবাসা মানুষের অন্তর থেকে আসে যা পবিত্র। তা দেশ ও জাতির জন্যে গৌরবের। কিন্তু উগ্র ও অন্ধ স্বদেশপ্রেম কল্যাণের পরিবর্তে রচনা করে ধ্বংসের পথ। অন্ধ স্বদেশপ্রেম উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। তা জাতিতে জাতিতে, সংঘাত ও সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জার্মানিতে হিটলার ও ইতালিতে মুসোলিনি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও অস্ব দেশপ্রেমের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল। তার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটেছিল। বিপন্ন হয়েছিল বিশ্বমানবতা। এ-ধরনের উগ্রতায় মানুষের চির অকল্যাণ, চির অশান্তি। উগ্রতা কখনো দেশ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়।
স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতিঃ
বস্তুত রাজনীতিবিদদের প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের পবিত্র বেদিমূলেই রাজনীতির পাঠ। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ দেশের সদাজাগ্রত প্রহরী। দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে রাজনীতি করেছেন বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়াদীসহ প্রমুখ রাজনীতিবিদ।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমঃ
স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। দেশকে ভালোবেসে মানুষ বিশ্বকে ভালোবাসতে পারে। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম কখনো বিশ্বপ্রেমের পথে বাধা হতে পারেনা। বস্তুত, বিশ্বজননীর বুকের আঁচলের ওপর দেশজননীর ঠাঁই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
'ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।'
দেশপ্রেম ও আমাদের কর্তব্যঃ
দেশের প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। পৃথিবীতে বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী মহৎ দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যা কম নয়। দেশে দেশে এই মহৎ মানুষেরা তাদের ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন। তাঁরা এই পৃথিবীকে করতে চেয়েছেন সুন্দর, কল্যাণকর, শান্তিময়। যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে তাঁরা জীবন উৎসর্গ করেন মানুষ সেই ত্যাগ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনকে আরো দুঃখময় করে তোলে।
আমরা যদি বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী দেশপ্রেমিকদের মর্যাদা দিতে চাই তাহলে। তাদের কর্ম ও আদর্শকে মূল্য দিতে হবে। তাহলেই তাদের জীবনদান ও দেশপ্রেম সার্থক হবে। আর এটাই হচ্ছে দেশপ্রেমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ উপায়। এটাই হচ্ছে দেশপ্রেমের আসল বহিঃপ্রকাশ।
উপসংহারঃ
দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ ও অমূল্য সম্পদ। এই স্বদেশপ্রেম এক জ্বলন্ত মহৎ প্রেরণা। সে প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা য্যক্তিগত স্বার্থ চেতনার উঊর্ধ্বে উঠি। যুক্ত হই সমষ্টির কল্যাণ চেতনায়। দেশের সংকটে ঐক্যবদ্ধ হই। সব অমঙ্গল থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হই। দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে সাধ্যমতো অবদান রাখি।