অ্যানজাইনা (Angina) বা হৃদশূল ও হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack or Myocardial Infarction) এর বর্ণনা
অ্যানজাইনা (Angina) বা হৃদশূল ও হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack or Myocardial Infarction) এর বর্ণনা
আমাদের কমবেশি প্রায় সকলেরই কোন না কোন কারনে বুকে ব্যথা হয়ে থাকে আপনার এই বুকে ব্যথা অ্যানজাইনা বা হার্ট অ্যাটাক এর কোন লক্ষণ কি না তা জানতে নিম্নলিখিত লিখাগুলো পড়ে দেখতে পারেন তাহলে আপনি একটি সঠিক ধারণা পাবেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করতে পারবেন
অ্যানজাইনা (Angina) বা হৃদশূল কি
অ্যানজাইনা (Angina) বা হৃদশূলঃ নানা কারণে বুকে ব্যথা হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হৃৎপিন্ডজনিত বুক ব্যথা। হৃৎপেশি যখন O₂-সমৃদ্ধ পর্যায় ক্ত সরবরাহ পায় না তখন বুক নিষ্পেষিত হচ্ছে বা দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন মারাত্মক অস্বস্তি অনুভূত হলে সে ধরনের। কে ব্যথাকে অ্যানজাইনা বা অ্যানজাইনা পেকটোরিস (angina / angina pectoris) বলে। অ্যানজাইনাকে সাধারণত র্টি অ্যাটাকের পূর্বাবস্থা মনে করা হয়।
অ্যানজাইনা কত প্রকার
অ্যানজাইনার প্রকার (Types of Angina) সাধারণত তিনি ধরনের অ্যানজাইনা হয়ে থাকে, যথা-
i. সুস্থিত অ্যানজাইনা (Stable Angina): এক্ষেত্রে বুকের ব্যথা অনুভূত হয় কেবল পরিশ্রম কিংবা চরম আবেগীয় বিষন্নতার কারণে। বিশ্রাম নিলে এ ব্যথা চলে যায়।
ii. অস্থিত অ্যানজাইনা (Unstable Angina): বিশ্রামের সময় বুকের ব্যথা অনুভূত হলে তাকে অস্থিত অ্যানজাইনা বলা হয়। এ ব্যথা প্রায়শই হয়ে থাকে এবং অনেক সময়ব্যাপি প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এ ধরনের অ্যানজাইনা হার্ট অ্যাটাকের পূর্ব লক্ষণ।
iii. প্রিনজমেটাল অ্যানজাইনা (Prinzmetal Angina): বিশ্রামের সময় কিংবা ঘুমের সময় কিংবা ঠাণ্ডার কারণে এ ধরনের অ্যানজাইনা দেখা দেয়।
অ্যানজাইনার লক্ষণ (Symptoms of Angina)
- ১. উরঃফলক বা স্টার্নামের (sternum) পিছনে বুকে ব্যথা হওয়া।
- ২. ব্যায়াম বা অন্য শারীরিক কাজে, মানসিক চাপ, অতি ভোজন, শৈত্য বা আতংকে বুকে ব্যথা হতে পারে। ব্যথা ৫-৩০ মিনিট স্থায়ী হয়।
- ৩. অ্যানজাইনা গলা, কাঁধ, চোয়াল, বাহু, পিঠ এমনকি দাঁতেও ছড়াতে পারে।
- ৪. অনেক সময় ব্যথা কোথেকে আসছে তাও বোঝা যায় না।
- ৫. বুকে জ্বালাপোড়া, চাপ, নিষ্পেষণ বা আড়ষ্ট ভাব সৃষ্টি হয়ে অস্বস্তির প্রকাশ ঘটায়। ৬. বুকে ব্যথা ছাড়াও হজমে গন্ডগোল ও বমি ভাব হতে পারে।
- ৭. ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া কিংবা দম ফুরিয়ে হাঁপানো দেখা দিতে পারে।
অনেক রোগী অ্যানজাইনা টের পায় না, তবে কাঁধ ও বাহু ভারী হয়ে আসে। বুকে ব্যথার সাথে সাথে ঘাম হয়, মাথা রিমঝিম করে বা শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যায়। রোগী চিন্তান্বিত থাকে, মাথা ঝুলে থাকে। সারাদিন দুর্বল ও পরিশ্রান্ত থাকে এবং তখন সহজ কাজও কঠিন মনে হয়।
অ্যানজাইনা (Angina) বা হৃদশূল করণীয় / প্রতিকার (Control)
সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া এবং তা ধরে রাখাই হচ্ছে অ্যানজাইনা প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এজন্যে কিছু বিষয় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা উচিত। কিছু বিষয় আছে যার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই, যেমন-বয়স, লিঙ্গভেদ, হৃদরোগ ও অ্যানজাইনার পারিবারিক ইতিহাস। যে সব বিষয় আমাদের নাগালে তার মধ্যে রয়েছে:
- ১. রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ECG ও ইকোকার্ডিওগ্রামের মাধ্যমে ব্যথার কারণ নির্ণয় করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে হবে।
- ২. রোগের অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসক অপারেশন অথবা এনজিওগ্রামের পরামর্শ দিতে পারেন।
- ৩. এছাড়াও ধূমপান ও মদপান পরিহার করতে হবে।
- ৪. নিয়মিত পরিমিত ব্যায়াম বা হাঁটা-চলা, কায়িক পরিশ্রম করা, আলস্য পরিহার, স্থূলতা রোধ করা ইত্যাদি।
- ৫. সুষম ও হৃদ-বান্ধব খাবার খেতে হবে।
- ৬. ডায়োবেটিস, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি ব্যবস্থা অবলম্বনে অ্যানজাইনাল ব্যথার সম্ভাবনা কমে।
হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack or Myocardial Infarction) কি
হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack or Myocardial Infarction): হৃৎপেশির সুস্থতার জন্য ক্রমাগতভাবে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ জরুরি। করোনারি ধমনির মাধ্যমে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত পেশিতে পৌঁছায়। চর্বি জাতীয় পদার্থ, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন প্রভৃতি করোনারি ধমনির অন্তর্গাত্রে জমা হয়ে বিভিন্ন আকৃতির প্লাক (plaques) গঠন করে।
আরো পড়ুনঃ হৃদরোগের বিভিন্ন অবস্থায় করণীয়
একে করোনারি অ্যাথেরোমা (coronary atheroma) বলে। প্লাকের বহির্ভাগ ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠে। এভাবে প্লাক শক্ত হতে হতে যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন এগুলো বিদীর্ণ হয়। অণুচক্রিকা জমা হয়ে প্লাকের চতুর্দিকে তখন রক্ত জমাট বাঁধাতে শুরু করে। রক্ত জমাট বাঁধার কারণে করোনারি ধমনির লুমেন (গহ্বর) সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে হৃৎপেশিতে পুষ্টি ও অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্তের সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়, ফলে হৃৎপেশি ধ্বংস হয় বা মরে যায় এবং মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর নাম হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (myocardial infarction; 'মায়োকার্ডিয়াল' অর্থ হৃৎপেশি, আর 'ইনফার্কশন' অর্থ প্লাক অপর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহের কারণে টিস্যুর মৃত্যু)।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
করোনারি ধমনিতে কোলেস্টেরল জাতীয় পদার্থ জমা হওয়া থেকে হার্ট অ্যাটাকে পরিসমাপ্তি হওয়া পর্যন্ত অনেক দিন অতিবাহিত হয়। এ সময়ের ভিতর বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
চিত্র ৪.২৯: প্লাক গঠন
১ . বুকে ব্যথা (Chest-pain): বুকের ঠিক মাঝখানে অস্বস্তি হওয়া যা কয়েক মিনিট থাকে, চলে যায় আবার ফিরে আসে। বুকে অসহ্য চাপ, মোচড়ান, আছড়ান বা ব্যথা অনুভূত হয়।
২. ঊর্ধ্বাঙ্গের অন্যান্য অংশে অস্বস্তি (Discomfort in other areas of the upper body): এক বা উভয় বহ, পিঠ, গলা, চোয়াল বা পা উপরের অংশে অস্বস্তি বা ব্যথা অনুভব।
৩. ঘন ঘন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস (Shortness of breath): বুকে অস্বস্তির সময় ঘন ঘন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ঘটে। অনেক সময় বুকে অস্বস্তি হওয়ার আগেও এমন অবস্থা দেখা দিতে পারে।
৪. বমি-বমি ভাব (Nausea) বা বমি হওয়াঃ পাকস্থলিতে অস্বস্তির সঙ্গে বমি-বমি ভাব, বমি হওয়া, হঠাৎ মাধ্য ঝিমঝিম করা অথবা ঠান্ডা ঘাম বেরিয়ে যাওয়া।
৫. ঘুমে ব্যাঘাত (Sleep disturbance): ঘুমে ব্যাঘাত ঘটা, নিজেকে শক্তিহীন বা শ্রান্ত বোধ করা।
হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack or Myocardial Infarction) প্রতিরোধ
১. ঋতুকালীন টাটকা ফল ও সবজি খেতে হবে।
২. চর্বি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে।
৩. বডি-মাস ইন্ডেক্স (Body Mass Index, BMI) মেনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।
৪. সঠিক ওজন, রক্তে কোলেস্টেরল মাত্রা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম (যেমন- প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা ইত্যাদি) করতে হবে।
৫. ধূমপায়ী হলে অবশ্যই ধূমপান ত্যাগ করতে হবে, অধূমপায়ী হলে ধূমপান না করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
৬. জীবনাভ্যাসে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ রাখতে হবে।
৭. কোলেস্টেরল, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৮. চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে বা বন্ধ করতে হবে।
৯. বছরে অন্তত একবার (সম্ভব হলে দুবার) সমগ্র দেহ চেকআপের ব্যবস্থা করতে হবে।
হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে মধ্যে পার্থক্য
সাধারণ মানুষের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। অনেক সময় দুটোকে এক করে দেখা হয়। নিচে এদের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হলো।